ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটি কথা বার বার বলে আসছে, তা হল এক দেশ, এক ভোট। ইদানিং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে সভাপতি করে যে কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি তাদের ১৮৬২৬ পৃষ্ঠার সুপারিশে সেই কথায় বলেছেন। সরকার ভেঙ্গে গেলে, পদত্যাগ করলে কিংবা কোনো নির্বাচিত সদস্য মারা গেলে অন্তর্বর্তী উপ -নির্বাচন করার কথা বলেছেন। এই ফর্মুলা সরকারের অর্থ সাশ্রয়ের যুক্তিকে নস্যাৎ করে। সরকার ও দেশবাসী যদি সত্যি এক দেশ, এক ভোট চায় তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কথা ভাবতে পারে। ভারতের মতো দেশে যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন জাতি ও জন -জাতির বাস সেখানে এই প্রক্রিয়া প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে। লিখেছেন পাশারুল আলম...
ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটি কথা বার বার বলে আসছে, তা হল এক দেশ, এক ভোট। ইদানিং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে সভাপতি করে যে কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি তাদের ১৮৬২৬ পৃষ্ঠার সুপারিশে সেই কথায় বলেছেন। সরকার ভেঙ্গে গেলে, পদত্যাগ করলে কিংবা কোনো নির্বাচিত সদস্য মারা গেলে অন্তর্বর্তী উপ -নির্বাচন করার কথা বলেছেন। এই ফর্মুলা সরকারের অর্থ সাশ্রয়ের যুক্তিকে নস্যাৎ করে। সরকার ও দেশবাসী যদি সত্যি এক দেশ, এক ভোট চায় তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কথা ভাবতে পারে। ভারতের মতো দেশে যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন জাতি ও জন -জাতির বাস সেখানে এই প্রক্রিয়া প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে। একইভাবে দেশের মধ্যে একাধিক ছোট বড় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে দেশের উন্নয়ন মূলক কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনী পদ্ধতি পর্যালোচনা করার পূর্বে আমরা ভারতের যে নির্বাচনী পদ্ধতি ও গণতন্ত্র বিদ্যমান তার উপর আলোকপাত করতে পারি। আমাদের দেশে ভোট ও গণতন্ত্র থাকলেও এর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কিছু মৌলিক সমস্যা দেখা যায়। যেমন, একটি প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল মাত্র ৩০% থেকে ৪০% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন, অথচ ওই কেন্দ্রের বাকি ৬০% থেকে ৭০% ভোটার তাদের বিরোধিতা করেন। এই ব্যবস্থার ফলে অনেক সময় গণতান্ত্রিক মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটে না। বিপরীতে, দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচন ব্যবস্থা অনেক বেশি অনুপাতিক এবং অধিকতর গণতান্ত্রিক প্রতিফলন নিশ্চিত করে। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে সাধারণত ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে, যে প্রার্থী একটি কেন্দ্রে সর্বাধিক ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন, এমনকি যদি তার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা মোট ভোটারের একটি ক্ষুদ্র অংশ হয়। এর ফলে একটি দল বা প্রার্থী মাত্র ৩০% থেকে ৪০% ভোট পেলেও সরকার গঠন করতে পারে, আর বাকি ৬০% থেকে ৭০% ভোটারের মতামত অবহেলিত থেকে যায়। এই পরিস্থিতি জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলনকে বাধাগ্রস্ত করে এবং গণতন্ত্রের মূল নীতির বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিনিধিত্বের আনুপাতিক ব্যবস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিদ্যমান, সেখানে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মূলে রয়েছে Proportional Representation (PR) পদ্ধতি। যা ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো অন্যান্য গণতন্ত্রে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ব্যবস্থার সাথে একটি স্বতন্ত্র বৈপরীত্য প্রদান করে। পিআর সিস্টেম, যা নিশ্চিত করে যে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার সরাসরি অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব পায়, প্রায়শই নির্বাচকদের বিভিন্ন মতামত প্রতিফলিত করার ক্ষমতার জন্য প্রশংসিত হয়। এখানে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়া অন্বেষণ করে, এর সুবিধাগুলি যেমন তুলে ধরব তেমনি এর চ্যালেঞ্জগুলি পরীক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে তুলনা করে দেখার চেষ্টা করব। উপরন্তু, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি কি সেটাও বিবেচনা করব।
দক্ষিণ আফ্রিকার গণতন্ত্র একটি বহুদলীয় ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে সংসদ এবং প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের নির্বাচন করার জন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সিস্টেমটি একটি বন্ধ-তালিকা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের উপর ভিত্তি করে, যেখানে ভোটাররা পৃথক প্রার্থীদের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলির জন্য তাদের ভোট দেন। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আসন বণ্টন করা হয় দলগুলোর ভোটের সংখ্যার অনুপাতে। প্রতিটি দল প্রার্থীদের একটি তালিকা জমা দেয়, এবং তাদের ভোট ভাগের উপর নির্ভর করে, তালিকার শীর্ষ থেকে প্রার্থীদের আসন বরাদ্দ করা হয়।
এই ব্যবস্থাটি দক্ষিণ আফ্রিকার বৈচিত্র্যময় সমাজের জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত, যা একাধিক জাতিগোষ্ঠী, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং সাংস্কৃতিক পটভূমি নিয়ে গঠিত। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সাহায্য করে যে সংখ্যালঘু এবং ছোট দলগুলির আইন প্রণয়নে একটি কণ্ঠস্বর রয়েছে, যা কয়েক দশকের বর্ণবৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসা এবং সামাজিক সংহতি এবং ন্যায়সঙ্গত শাসন বজায় রাখতে চাওয়া একটি দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতি ভারতের মতো দেশে কার্যকরী হলে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো সর্ব স্তরের মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ও দল গুলির প্রতিনিধি পাঠাতে সক্ষম হবে। কেননা, এই অন্তর্ভুক্তি এবং ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব প্রদান করে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান শক্তি হল এটি রাজনৈতিক দলগুলির বিস্তৃত পরিসরে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব দেয়। এমনকি ছোট দলগুলি যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্ব লাভের জন্য সংগ্রাম করতে পারে। তারা তাদের ভোটের ভাগের ভিত্তিতে আইনসভায় আসন সুরক্ষিত করতে পারে। এই অন্তর্ভুক্তি একটি একক দলের আধিপত্য রোধ করে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু-দলীয় সংলাপ ও সংযুক্তির অনুমতি দেয়। বর্ণবাদ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকায় এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে গণতন্ত্র বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন কণ্ঠের প্রতিনিধিত্ব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন বর্ণবাদ রয়েছে তেমনি ভারতে রয়েছে জাত ব্যবস্থা। এই জাত ব্যবস্থার কারণে হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও শাসন অব্যাহত। প্রত্যেক ভোটারের মতামত প্রতিষ্ঠা পেলে ন্যায় পাওয়ার অবকাশ অধিক থাকে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম ও জাত কেন্দ্রিক রাজনীতির প্রাধান্য প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট প্রক্রিয়ায় একটি ধারণা পোষণ করা হয় এবং বড় রাজনৈতিক দল গুলি যা প্রচার করে থাকে, তা হল, ছোট দলকে ভোট দিলে সেই ভোট নষ্ট হয়ে যায়। কেননা, প্রার্থীদের হারানোর জন্য দেওয়া ভোট প্রতিনিধিত্বে অবদান রাখে না। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নষ্ট ভোটগুলিকে কমিয়ে দেয়। একটি দল কতটি আসন জিতবে তা নির্ধারণের জন্য প্রতিটি ভোট গণনা করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যটি নিশ্চিত করে যে, ভোটারদের পছন্দের আরও সঠিক প্রতিফলন অর্জিত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও ন্যায়সঙ্গতভাবে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতি কার্যকরী হলে শুধু মাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি নয়, অন্যান্য ছোট ছোট জন-গোষ্ঠী ও ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ গ্রহণের সুযোগ থাকে। অনগ্রসর, দলিত ও আদিবাসীদের ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চরমপন্থী শাসনকে প্রতিরোধ করতে সক্ষমতা অর্জন করে। আনুপাতিক ব্যবস্থা প্রায়শই জোট করে সরকার পরিচালনা করে। যেখানে কোনও একক দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকে না। দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতার জন্য এই প্রয়োজনীয়তা চরমপন্থী নীতির বিরুদ্ধে একটি বাফার হিসেবে কাজ করে, কারণ জোটের অংশীদারদের অবশ্যই আলোচনা এবং আপস করতে হবে। যার ফলে একে অপরের এজেন্ডা গুলিকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তেমনি জন- হিতকর সিদ্ধান্তগুলি কার্যকরী করতে পারে।
তবে একথা ঠিক, এই পদ্ধতির সমালোচনা কম হয়না। সমালোচকরা মনে করেন, এতে
সিস্টেমের বিভক্তকরণ এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। অনেক ছোট দল সংসদে আসন লাভ করে। যদিও এটি বিভিন্ন প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। এই কারনে স্থিতিশীল সরকার গঠন করাও কঠিন করে তুলতে পারে এবং জোট ভেঙে যেতে পারে। এছাড়া শাসক দলগুলি কার্যকরভাবে নীতিগুলিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিনিধি এবং সংবিধানের মধ্যে ক্লোজ-লিস্ট সিস্টেমের জন্য ভোটাররা স্বতন্ত্র প্রতিনিধিদের পরিবর্তে দলগুলিকে নির্বাচন করে। এর ফলে নির্বাচিত কর্মকর্তা এবং তাদের ভোটারদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। নাগরিকরা মনে করতে পারে যে, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী আইন প্রণেতাদের সাথে তাদের সরাসরি যোগসূত্র নেই, কারণ এই আইন প্রণেতারা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক নির্বাচনী এলাকার কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ নয়। এর ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি মোহভঙ্গ হতে পারে। আমাদের দেশে লোকসভার সদস্যরা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় দায়বদ্ধ থাকলেও রাজ্যসভার সদস্যরা কোন নির্দিষ্ট এলাকার সঙ্গে দায়বদ্ধ থাকে না। পি,আর, সিস্টেমে অনেকটা রাজ্যসভার সাংসদদের মতো হয়।
এছাড়া আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সাথে আরেকটি উদ্বেগ দলীয় আধিপত্য। বিশেষত এমন সিস্টেমে যেখানে দলগুলি প্রার্থীদের তালিকা উপস্থাপন করে থাকে। এর ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দলীয় অভিজাতদের আধিপত্যের সম্ভাবনা থাকে অধিক। কারণ প্রার্থী তালিকায় কাকে রাখা হবে, কাকে রাখা হবে না, তাতে দলীয় নেতাদের উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ থাকবে। যা দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে সীমিত করতে পারে এবং ভোটারদের জন্য উপলব্ধ পছন্দগুলিকে সীমিত করতে পারে। তবে প্রকাশিত তালিকায় সব দলে ক্রমানুসারে যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকার প্রথম দিকে রেখে ভোটারদের মন জয় করতে চাইবে।
এই সমালোচনার পরেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব
নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর বিশ্বব্যাপী একটি সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞরা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক করেছেন। বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরেন্ড লিজপহার্ট (Arend Lijphart) প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন ব্যবস্থার প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের মতামতকে প্রতিফলিত করতে সহায়তা করে। তাছাড়া, জিওভান্নি সার্থোরি (Giovanni Sartori) তার তত্ত্বে দেখিয়েছেন, বহুদলীয় রাষ্ট্রে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতি রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক। যা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো গভীর জাতিগত, ভাষাগত বা ধর্মীয় বিভেদ সম্পূর্ণ সমাজে বিশেষভাবে উপকারী। উল্টোদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ব্যবস্থা, যা দুই-দলীয় আধিপত্যের পক্ষে থাকে, ছোট, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ গোষ্ঠীগুলিকে বন্ধ করে বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। অন্যদিকে, জিওভান্নি সার্টোরির মতো সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন যে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব জোট গঠনের জটিলতা এবং আইন প্রণয়নে অচলাবস্থার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া শাসন ব্যবস্থা অদক্ষতার দিকে পরিচালিত হতে পারে। একাধিক মতাদর্শের কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। তাঁর মতে একাধিক ভেটো প্লেয়ার আইন পাস এবং নীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়।
জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলি, যা নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক ভোটের সাথে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিকে সফল মডেল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা আনুপাতিক ভোটের অন্তর্ভুক্তির সাথে সরাসরি প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তার ভারসাম্য বজায় রাখে। এই ব্যবস্থাগুলির লক্ষ্য হল উভয় পদ্ধতির সুবিধা ধরে রাখা, ভোটারদের জবাবদিহিতা প্রদান করার পাশাপাশি সংখ্যালঘু দলগুলিকে শাসন থেকে বাদ দেওয়া হয় না। যা এই দেশ নিশ্চিত করেছে। এই মিশ্র ভোট পদ্ধতি উভয় ব্যবস্থাকে যেমন ধরে রাখে তেমনি সর্বস্তরের জনসমাজ ও ছোট বড় রাজনৈতিক দলেরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সমস্যার সমাধান কল্পে
দক্ষিণ আফ্রিকায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সম্ভাব্য ত্রুটিগুলি মোকাবেলা করার জন্য, বেশ কয়েকটি সমাধান বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন, একটি মিশ্র-সদস্য সিস্টেম প্রবর্তন। ভারতীয়রা একটি মিশ্র-সদস্য আনুপাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের অন্বেষণ করতে পারে। যা জার্মানিতে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সাথে নির্বাচনী-ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বকে একত্রিত করবে। ভোটাররা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন করার অনুমতি দেবে এবং এও নিশ্চিত করবে যে, দলীয় ভোটের ভাগ সংসদে প্রতিফলিত হচ্ছে। এই অত্যাধুনিক সিস্টেম আনুপাতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি বজায় রেখে প্রতিনিধি এবং তাদের উপাদানগুলির মধ্যে সংযোগকে শক্তিশালী করতে পারে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় দলীয় অভিজাতদের আধিপত্য হ্রাস করতে পারে। অনেকটা সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার মত করে প্রার্থী তালিকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। দলের সদস্যদের মতামত রয়েছে এমন প্রার্থী নিশ্চিত করার মাধ্যমে দলগুলি প্রাক নির্বাচন পর্যায়ে প্রার্থী তালিকা তৈরি করতে পারে। দলগুলি ভোটারদের দাবির প্রতি সহমর্মি হতে পারে এবং ভোটার ও প্রতিনিধিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি হ্রাস করতে পারে।
জোট সরকার পরিচালনা করার জন্য নিয়ম রীতি তৈরি করা আবশ্যক। জোটের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমাতে, আনুষ্ঠানিক কোয়ালিশন গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্ক গ্রহণ করতে পারে। এই কাঠামোগুলি জোট চুক্তির জন্য স্পষ্ট নিয়ম নির্ধারণ করবে, যার মধ্যে থাকবে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং নীতি সমঝোতার প্রক্রিয়া। যাতে সরকারগুলি স্থিতিশীল এবং কার্যকরী থাকে তা নিশ্চিত করবে।
সবিশেষ বলা যায়, ভারতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করলে দেশের গণতন্ত্রে বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যাকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ভারত সরকার যেখানে বারবার বলছে এক দেশ, এক ভোট। একে কার্যকরী করতে গেলে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভোট প্রক্রিয়ার বিকল্প নেই। এই ভোট প্রক্রিয়ায় প্রার্থীর কোন ব্যক্তিগত খরচ যেমন হবে না, তেমনি সরকারিভাবে ভোটের খরচ বিষয়ে প্রচুর পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। উপ নির্বাচনের বালাই থাকবে না। পদত্যাগ, দল বদল বা মারা গেলে তালিকার পরবর্তী ব্যক্তি সদস্য হয়ে উঠে আসবেন।
জাত -ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম ভিত্তিক বিভাজন ও রাজ্যে ভিত্তিক স্বার্থ রক্ষায় এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এই পদ্ধতিতে যেমন নষ্ট ভোট কমানো যাবে তেমনি চরমপন্থী আধিপত্য রোধ করা সম্ভব হবে। এতে রাজনৈতিক বিভক্তকরণ এবং দলীয় আধিপত্যের মতো বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একটি মিশ্র-সদস্য ব্যবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্রের উন্নতির মতো সংস্কার গ্রহণ করে, ভারত তার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা আরও বাড়াতে পারে। বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিগুলি বিচার বিশ্লেষণ করে ভারতের মতো দেশে প্রত্যেক ভোটারের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করার সময় এসেছে বলে মনে হয়। গণতান্ত্রিক শাসনকে আরও ভালভাবে পরিবেশন করার জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বকে কীভাবে পরিমার্জিত করা যেতে পারে সে সম্পর্কে একটি সার্বিক আলোচনা হওয়া আবশ্যক। দলিত ও অনগ্রসর রাজনীতিবিদরাও এই বিষয়ে ভাবতে পারেন। এক্ষেত্রে দেশের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী মানুষ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct