মোল্লা মুয়াজ ইসলাম, আপনজন: অবক্ষয়ের আবর্তে যখন আমরা সকলেই অল্প বিস্তর আবর্তিত, সমাজ জীবন অনেকাংশে বিপর্যন্ত, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা স্তব্ধ প্রায়, সৃষ্টি ভুলে যাচ্ছে তার স্রষ্টাকে, ধরাভূমে আসার উদ্দেশ্য বিস্মৃত প্রায়, বিশ্বচরাচর যে একই পরিবার, আমরা যে সবাই একই পরিবারের সদস্য - ভুলেই যেতে বসেছি সে কথা। স্বার্থান্ধতা, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, নিজেকে নিয়েই মগ্ন থাকার অন্ধকারে নিমজ্জিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, দেশ। সংকটের এই যুগ সন্ধিক্ষণে মোল্লা গোলাম আসপিয়া এক ব্যতিক্রমী আদর্শ চরিত্র। যিনি হাজী কুতুবুদ্দিন নামেই সমধিক পরিচিত। একশো শতাংশ তিনি নিজ ধর্ম পালনে আন্তরিক ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও অপর ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আপামর জনসাধারণের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি আবৃত্তি, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, বিতর্কে জেলার গন্ডী ছাড়িয়ে রাজ্যাস্তরের পুরস্কারে পুরষ্কৃত।এছাড়াও সাহিত্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক জগতের তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র। কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটো গল্প রচনাই নয়- সংবাদপত্র ও সাহিত্য সম্পাদনায় মুন্সীয়ানায় তিনি স্বাক্ষর রেখেছেন।
তিনি স্বর্ণালী বাংলা নিউজ গ্রুপ ও সেহারাবাজার নাগরিক কমিটির তরফে থানার সেরা ব্যাক্তিত্ব হিসাবে ‘খণ্ডঘোষ রত্ন’ পুরস্কারে পুরস্কৃত। সারা ভারত রাইটার্স গিল্ডের সহযোগিতায় ম্যাসেঞ্জার পত্রিকার উদ্যোগে বর্ধমান জেলায় সেরা শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী হিসাবে তিনি “সেরা বর্ধমান পুরস্কারে” পুরস্কৃত। বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসাবে কলিকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘নতুন গতি’ পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়েও দরদি মনের পরশে এসব পুরস্কারের থেকেও বড় পুরস্কার জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের মনের মণিকোঠায় তিনি জায়গা করে নিয়েছেন। গরীব, অসহায়, অসুস্থ, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বৎসর আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা, প্রতি বৎসর শীতবস্ত্র, খাদ্য প্রদানের সাথে সাথে বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, বজ্রাঘাত যখনই কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে, তখনই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিপদগ্রস্থ মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতায়। এলাকার খুদকুড়ি গ্রামের ১৩ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী ফেরার পথে বাস দুর্ঘটনায় নিহত হলে, সেই অসহায় পরিবারগুলির পাশে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে তিনি ও তাঁর ট্রাস্টি হাজির হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন, সে খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কার্গিল যুদ্ধোত্তর শহীদদের সাহায্যার্থে, আসামে দাঙ্গা বিধ্বস্ত পরিবারদের গৃহ নির্মাণে, গাজা উপত্যকায় বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে গোটা এলাকাকে প্রতিবাদে মুখরিত করতে, এমনকি আন্তর্জাতিকস্তরে নেপালে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মানুষদের পাশেও ত্রাণ নিয়ে অসুস্থ শরীরে নিজে হাজির হয়েছেন তিনি, যা সংবাদপত্রে তার ছবিসহ বের হয়েছে। এসব তাঁর মানবিক ভূমিকার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত - আমাদের চোখের সামনে, মনের দর্পণে জাতিধর্ম নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের জন্য বিনা ব্যয়ে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে বেসরকারী হসপিটাল ও রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অসহায় গৃহহীন ও প্রতিবন্ধীদের মাথা গোঁজার ঠিকানা করে দিতে গৃহ নির্মাণে হাত লাগিয়েছেন তিনি নিজেই। ‘পুরিহা হইতে সেহারাবাজার’ ক্যানেল পাড়ে রাস্তা তৈরি হয়েছে ৩৫ বৎসর পূর্বে তাঁর নেতৃত্বে ‘পুরিহা নবীন যুব সংঘের ছেলেদের দ্বারা।
তিনিই যেন প্রকৃতই সোনাুল ও সুস্থ সমাজ গড়ার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। যাদের কথা কেউ ভাবে না তাদের জন্য তিনি ফেরি করেছেন, সমাজকে তিনি নাড়া দিয়েছেন - দিচ্ছেন একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে। একজন ধর্মপ্রাণ ধার্মিক মানুষ। তার নিজ ধর্মের পুরো দায়িত্ব পালনে বদ্ধ পরিকর থেকেও যে দেশ ও দশের কল্যাণে সুস্থ সোনালী সমাজ তৈরিতে ও মানুষের পাশে মানুষের সাথে থাকাও যায়, তার বিরল দৃষ্টান্ত তিনি।
মোল্লা গোলাম আসপিয়া ওরফে ‘হাজী কুতুবুদ্দিন’ -এরজন্ম ইংরেজি ১৯৫৯ সালের ৩রা জানুয়ারি পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ থানা সগড়াই অঞ্চলের পুরিহা গ্রামে। আব্বা মরহুম হাজী মোল্লা আহম্মদ হোসেন, মা মরহুমা হাজ্জীনা মতিয়েন্নেসা বিবি। হাজী কুতুবুদ্দিন সাহেব গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে রায়না থানার আলমপুর হাইস্কুল থেকে সসম্মানে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শ্যামসুন্দর মহাবিদ্যালয় হতে ইউ.ই ও বাংলা অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হওয়ার পরই বাংলা নিয়ে কলিকাতা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর লাউদোহা হইতে বেসিক ট্রেনিং-এ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০০ সাল হইতে প্রথমে কামদেবপুর ও দু’বছর পর কাঁটাপুকুর ওয়াজেন্নেশা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা করে ২০১৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই মানুষের পাশে মানুষের সাথে থাকার মহানব্রতে ব্রতী। গ্রাম ও এলাকার অসহায় গরীব মানুষদের চরম ও পরম ভরসাস্থল হাজী সাহেব। কন্যাদায়গ্রস্থ পরিবার, ক্যান্সার আক্রান্ত, অসহায় মানুষ, অসুস্থ গরীব, দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র, মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তবের উন্নয়নকামী সাহায্যপ্রার্থী মানুষ, পারিবারিক বা প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদে জর্জরিত মানুষ, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় জড়িত মানুষেরা - এককথায় হাজারো সমস্যায় জর্জরিত মানুষেরা প্রায় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষেরা হাজী সাহেবের শরণাপন্ন হন। আজও প্রায় প্রতিদিন ১২-১৫ জন তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। পাক্ষিক পত্রিকা ‘জনতার আদালত’ আজ থেকে প্রায় ১০-১২ বছর পূর্বে হাজী কুতুবুদ্দিনকে ‘মুশকিল আসান’ হাজী সাহে হিসেবে বর্ণিত করে প্রতিবেদন প্রকাম করেছিল।
হাজী সাহেব বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একজন মানুষ আবৃত্তি, বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় জেলা ও রাজ্যে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাপ্রাপ্ত, এই ব্যক্তিত্বের অনুষ্ঠান পরিচালনা ও সঞ্চালনা দেখে প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রয়াত অধ্যাপক সোহরাব হোসেন বলেছিলেন, “আমি আজ পর্যন্ত এত সুন্দর বলিষ্ঠ কন্ঠে সুন্দরবাক্য বিন্যাসে সঞ্চালনাকে একটি শিল্প সুষমার সু-শোভিত করতে কাউকে দেখিনি। আমার দেখা সেরা সঞ্চালক হাজী কুতুবুদ্দিন সাহেব।” প্রখ্যাত লেখক ও আলিয়ার প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রয়াত অধ্যাপক আইনুল বারী হাজী সাহেবের কণ্ঠে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতার আবৃত্তি শুনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত সুলতান আহমেদের সামনে আবেগপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, আজ সুকান্ত বেঁচে থাকলে হাজী সাহেবের আবৃত্তি শুনে বড় খুশি হতেন। তিনি যখন কলেজে ইউনিভার্সিটি চত্বরে তখন তিনি বিশাখা পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। দুটি পাক্ষিক সংবাদপত্র দক্ষিণ দামোদরের কথা ও দক্ষিণ দামোদর প্রকাশন পত্রিকার সহ-সম্পাদক। ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবলে ক্রিকেটে রাজত্ব করেছেন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতির জগতের উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। এমনকি ফুটবল মাঠে সফল রেফারি হিসাবে তার পদচারণা। দক্ষিণ দামোদরের আজ থেকে ৩৮ বছর পূর্বে সর্বপ্রথম রক্তদান শিবির করেছেন পুরিহা গ্রামে। ৩৮ বছর পূর্বে দক্ষিণ দামোদরের সর্বপ্রথম সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতির প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, গুণীজন সংবর্ধনা, সাহিত্য সভা, রক্তদান শিবির প্রভৃতির জনক এই হাজী সাহেব। পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাক্ষরতা অভিযান প্রকল্প চালুর ৪ -৫ বছর পূর্বেই হাজী সাহেব তার মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাভাবনা দিয়ে গ্রামের সাঁওতাল, আদিবাসী, হিন্দু, মুসলমান যারা নিরক্ষর তাদেরকে পরিহা-র নবীন যুব সংঘের ব্যানারে শ্লেট, পেন্সিল, খাতা, বই দিয়ে স্বাক্ষরতা ক্যাম্প শুরু করেন। নিরক্ষর মানুষদের স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন করার জন্য তদানীন্তন সময়ের সদর মহকুমা শাসক কল্লোল ভট্টাচার্য গ্রামের বুকে এইরকম এক শিক্ষা আন্দোলনের জন্য হাজী সাহেবের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ দামোদরের ভূমিপুত্রদের মধ্যে ২০২২ সালে ৩৩ টি বিভাগের সেরাদের প্রতিযোগিতা ‘শতক সম্মাননায়’ শতাধিক বিচারকের রায়ে আবৃত্তি, বিতর্ক, বক্তৃতা, সঞ্চালনা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সমাজসেবী, সংগঠক ও সাহিত্যিক হিসেবে ৮টি বিভাগের সেরা এবং সেরাদের সেরা নির্বাচিত হন হাজী কুতুব উদ্দিন ।
১৯৯০ সালে ৩১ বছর বয়সে তরুণ তুর্কি জলজাহাজে হজব্রত পালন করেন। দ্বিতীয়বার হজে যান ২০১০ সালে সস্ত্রীক। ২০১১ থেকে প্রায় প্রতি বছর উমরাহ সফরে পবিত্র মক্কা মদিনায় যাচ্ছেন। ২০১৯-এ এক বছরেরও বেশি সময় নিয়ে দ্বীনের মেহনতে অর্থাৎ দাওয়াত এ তাবলীগের কাজে দিল্লি, আন্দামান, ভূপাল, বান্দ্রা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মুম্বাসা, কেনিয়া সফর করেন।
আপাদমস্তক ধর্মপ্রাণ মানুষ হাজী সাহেব। নিজ ধর্মের সব কানুনকে মান্যতা দিয়ে চলেন, কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি চরম শ্রদ্ধাশীল।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা বাহক শুধু নন, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এলাকার সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধাশীণ। তার শরীর অসুস্থ হলে অন্য ধর্মের মানুষেরাও তার রোগ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন। এহেন ব্যতিক্রমী এক চরিত্রের মানুষ হাজী কুতুবুদ্দিন সাহেব তৈরি করেন তার স্বপ্নের এক প্রতিষ্ঠান সেহারাবাজার রহমানিয়া ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। মানবসেবায় নিয়োজিত দেশের অনন্য এই প্রতিষ্ঠান জন্ম দিয়েছে একে একে ১৩ টি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাহিত্য, সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সাথে সাথে হজ ও উমরাহ বিষয়ক বিভাগ, বেসরকারি হাসপাতাল শেফা দাতব্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র যা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য। সারা বৎসর অসহায় গরিব, গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ও অসুস্থ ব্যক্তিকে নগদ সাহায্য শীত ও ঈদকে সামনে রেখে বৎসরে দুবার দেড়শতাধিক গ্রামের অসহায় মানুষদের বস্ত্র প্রদান, এলাকার প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার ও হাত চালানো সাইকেলের প্রদান, যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাদের নিখরচায় থাকার জন্য তৈরী করেন সেহারাবাজার রহমানিয়া ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের নিয়ন্ত্রণে ‘আবাসন’ নামে বিন্ডিং। সাংবাদিকদের জন্য তৈরি করে দিলেন ‘প্রেস ক্লাব’। তিনি মানুষের পাশে, মানুষের সাথে থাকার মহান ব্রতে ব্রতী হওয়ার ১৩টি প্রতিষ্ঠানের জনক শুধু নন, কর্ণধার বা প্রাণপুরুষ শুধু নন, বয়সের ভারে নুব্জ শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দানের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গোটা এলাকা মানুষের মনে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের জায়গায় তিনি প্রতিষ্ঠিত। ৬৬ টি বসন্ত পার করা হাজী সাহেব বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে আজও সাবলীলভাবে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে সামনে থেকে দাঁড়িয়ে শুধু নেতৃত্ব দেওয়াই নয়, সুন্নতি পোশাকে মোড়া নিপাট ভদ্রলোক দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে দেশ-বিদেশে সফর, দ্বীনি কাজে রাজ্য-জেলা সফর, মানুষের পাশে, মানুষের সাথে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, মানুষকে সঠিক দিশা দেখানোর জন্য দিন রাত পরিশ্রম করা সদাহাস্যময় ব্যক্তটির মিষ্টি ব্যবহার, মানুষের ব্যথায় সমব্যথী হয়ে থাকা, সকলের সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনে সমাধানের রাস্তা বের করে দেওয়া - জমিদারের ছেলে হয়েও সাদাসিধে জীবন যাপন তাকে মানুষের হৃদয়ে আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে।
যেখানে সারাদেশ খেলা ও মেলায় মেতে উঠেছে, সেখানে আজ ১১ বছর ধরে হাজী সাহেবের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাভাবনার ফসল সমাজকে সুস্থ রাখতে ও শুভ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে তিন দিন ধরে সারাদেশের মধ্যে এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান ‘চেতনা উৎসব’ সারাদেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। যেখানে মাদ্রাসা শিক্ষা, মিশন শিক্ষা, নারী শিক্ষা, শিশু শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, দাওয়াত, খানকা, জমিয়েত ও মাদ্রাসার সমন্বয় সাধন, গুণীজন তথা মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক মাদ্রাসার কৃতি ছাত্রদের সম্বর্ধনা, রক্তদান উৎসব, অসহায়, গরিব, অসুস্থ ও মেধাবী দরিদ্র পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সাহায্য, প্রায় দেড় শতাধিক গ্রামের গরিব পরিবারদের শীতবস্ত্র প্রদান, প্রতিবন্ধীদের সাইকেল প্রদান সহ বাংলার খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সামনে এলাকার অনামী কবি সাহিত্যিকদের প্রতিভাকে তুলে ধরার সাহিত্য মজলিসসহ এক অনন্য সাধারণ তিন দিবসীয় অনুষ্ঠান। পুরা তিনদিনের অনুষ্ঠান আজ ১১ বছর ধরে হাজী সাহেব অসুস্থ শরীর নিয়েও উপস্থিত থেকে নিজেই সঞ্চালনা করে চলেছেন।
হাজী সাহেব হাফেজ, মাওলানা নন - কিন্তু হাফেজ, মাওলানা, কারী, মুফতি সাহেবদের কাছে তিনি একজন সম্মানীয় ও অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বহু শাইখুল হাদীস, মুহাদ্দিসীন, উলামায়ে হজরতের অভিমত, ‘হাজী সাহেব প্রকৃত অর্থেই দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী। প্রামাণ্য দলিল - দক্ষিণ দামোদর ইমাম সংগঠনের তিনি প্রধান উপদেষ্টা। সাত সাতটি মোনাজ্জম মক্তবের পরিচালক। রাজ্যের স্বনামধন্য মাদ্রাসা ‘দারুল উলুম সেহারাবাজার- যেখানে শুধু হিফ্জ, কেরাত, দাওরা হাদিস নয়, সুনামের সঙ্গে ইফতা বিভাগের শবক চলছে, ফতোয়া বিভাগ চলছে - এহেন বাংলার প্রথম সারির মাদ্রাসার ৩১ বৎসর ধরে সুনামের সাথে সম্পাদক হিসাবে কাজ করে চলেছেন। ধর্মীয় জলসায় যুক্তিবাদী বক্তা হিসেবে সর্বত্রই সমাদৃত। বিষয়ভিত্তিক যুক্তিবাদী বক্তৃতায় বাংলার অন্যতম সেরা বক্তা হাজী কুতুবুদ্দিনন বলে অনেকে মনে করেন। যদিও সময়ের অভাবে আর জলসায় যান না, অবশ্য এলাকায় জনসাধারণের ভালবাসার দাবিতে প্রায় সর্বত্রই এখনও তার উপস্থিতি বিনা পারিশ্রমিকে। দক্ষিণ দামোদরের দুই শতাধিক গ্রামীণ চিকিৎসক সংগঠনেরও তিনি প্রধান উপদেষ্টা। চিকিৎসক সংগঠনের বিভিন্ন সভা এমনকি জেলা সম্মেলনেও তার গৌরবজ্জ্বল উপস্থিতি। সমাজের সর্বোস্তরে তার যে কতটা গ্রহণযোগ্যতা এটা প্রামাণ্য তার দলিল। নূরানী শিশু নিকেতন, সেহারাবাজার রহমানিয়া আল আমীন মিশনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা - সম্পাদক - যেখানে নামমাত্র পয়সায় পড়াশুনা করানো হয়। হাজী সাহেবের সাথে একান্ত আলোচনায় আজানতে পারা যায়, তাঁর জীবনে তিন-তিনজন আল্লাহ্ওয়ালী মহিলার সদর্থক ভূমিকার কথা। প্রথম, তাঁর গর্ভধারিণী জননী হাজ্জীন মতিয়েন্নেসা বিবি। দ্বিতীয়, তাঁর মেজো দিদি হাজ্জীন লুৎফা বেগম– মায়ের মতো করে স্নেহ দিয়ে মানুষ করছেন; তাঁরই স্নেহছায়ায় বড় হয়েছেন। তৃতীয়, তার সহধর্মিনী হাজ্জীন মীনা আহ্মেদ, তিনি শুধু সহধর্মিনী নন, কর্মসঙ্গিনী ও ধর্মসঙ্গিনীও। স্বামীর সাথে ১২ বার মক্কা-মদিনা সফর করেছেন। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে বিভিন্ন জেলাসহ ভারতবর্ষের বহু অঙ্গরাজ্যসহ সফর – এমনকি ২০১৮ সালে স্বামীর সাথে বিদেশ সফরও বাংলাদেশে। ২০২৩ সালে সস্ত্রীক, তিন নাতনী, এক নাতি, দুই পৌত্রী, দুই মেয়ে, দুই জামাই, একমাত্র ছেলে ও বৌমাকে নিয়ে গোটা পরিবার উমরাহ্ সফর করে এসেছেন। হাুজ সাহেবের অকপট স্বীকারোক্তি - সারা পৃথিবীর প্রকৃত অর্থে যারা সুখী পরিবার, তাদের মধ্যে আমি, আমার স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ-মেয়ে-জামাই, ফুলের মতো নাতি-নাতনি ও পৌত্রীদের নিয়ে অন্যতম সুখী পরিবার। আল্লাহর দেওয়ার শেষ নাই, আমি সব পেয়েছি – আমার কোনো অতৃপ্তি নেই, আমি তৃপ্ত। কিন্তু আমার যতটা আল্লাহ্কে ও তার বান্দা-বান্দীদের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করার দরকার ছিল, তা পারি নি। আমি পৃথিবীর সেরা অপরাধী। তবে তার ক্ষমার আশা অন্তরের অন্তঃস্থলে। হাজী সাহেবের অকপট স্বীকারোক্তি, অসংখ্য উলামা হজরত ও দ্বীনের দায়ীদের সান্নিধ্য ও দুয়া আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct