রাজ্যে এখন ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল সমস্যা চরম আকার নিয়েছে। কলকাতা হাইকোর্ট তৃণমূল সরকারের আমলে পাওয়া ওবিসিদের স্বীকৃতি বাতিল করায় তা নিয়ে বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। দিনে পর দিন মামলার শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় খুবই উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজ। কারণ, চাকরি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এনসিএল সার্টিফিকেট না মেলায় সঙ্কটের মধ্যে ছাত্র সমাজ। তাই ওবিসি বাতিল বিষয়টি এখন খুবই চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, কলকাতা হাইকোর্টের রায় মেনে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ না হয়ে বিধানসভায় বিল পাশ করে ওবিসিকে মান্যতা দিলে এত দীর্ঘসময় আর ওবিসি বঞ্চনার শিকার হতে হত না। সেই সব চলমান বিষয় নিয়ে ‘আপনজন’-কে অকপট সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এসসডিপিআই-এর রাজ্য সভাপতি তায়েদুল ইসলাম। তার সেই মূল্যবান অভিমত ‘আপনজন’ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করে কলকাতা হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে এসডিপিআইয়ের হয়ে মামলা আপনি মামলা করেছেন। এই মামলার ফল কী হতে পারে?
শুধুমাত্র এসডিপিআই এসএলপি করেছে তা নয়। আরও বেশ কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন করেছে। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে একমাত্র এস ডি পি আই করেছে। শীর্ষ আদালত অন্যদের তুলনায় আমাদের এসএলপি কে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। রাজ্য সরকারের করা মামলার সাথে আমাদের জুড়ে দিয়েছে। এক সাথে শুনবে এবং পৃথক ভাবেও স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়ে শুনবে।
এই মামলায় রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন?
আমাদের প্রথম থেকেই আশঙ্কা ছিল রাজ্য সরকার যথাযথ গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সাথে ভূমিকা পালন করবে কিনা। সেই আশঙ্কা অনেকটা সত্য প্রমাণিত হয় যখন রাজ্য সরকার এসএলপি র ত্রুটি সংশোধনের জন্য ৪০ দিন সময় নেয়। আমরা ত্রুটি সংশোধন করে শুনানির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিই। তার পরই রাজ্য সরকার সে কাজ করে। প্রথম শুনানির দিন শীর্ষ আদালত প্রকাশ্যেই মন্তব্য করে জরুরি সমস্যার কথা বলে স্থগিতাদেশ চাইছেন। ত্রুটি সংশোধনের সময় নিয়েছেন চল্লিশ দিন। তখন জরুরী প্রয়োজন কোথায় ছিল? তারপর রাজ্য সরকার পরপর তিনদিন শুনানিতে অংশগ্রহণ না করে সময় নেয়। এতে আমাদের সে আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়। গত ৮ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী আধিকারিকদের যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতেও প্রমাণ হয় তিনি এতদিন কোন নির্দেশ দেননি।
বর্তমানে ছাত্রছাত্রীরা যে সমস্যায় পড়েছেন তা থেকে বাঁচার পথ কী?
প্রথম পদক্ষেপ শীর্ষ আদালত থেকে হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ আদায় করা। দ্বিতীয়তঃ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়া। তৃতীয়ত রাজ্যজুড়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চালু রাখা।
শীর্ষ আদালতে না গিয়েও রাজ্য সরকার রাজ্য অনগ্রসর কমিশনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান কি করতে পারত?
o আমাদের ভাবনায় এটা সঠিক কথা নয়। সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তা ছাড়াও সে প্রক্রিয়ার মধ্যেও অনেক ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য বিরোধীরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাইকোর্ট তো রাজ্য ওবিসি আইনের ২০০৯ পরবর্তী সমস্ত সংশোধনী বাতিল করেছে। সাচার কমিটির রিপোর্ট মানতেই চায়নি। তাকে অসাংবিধানিক বলে ছে। আসলে বর্তমান ইউনিয়ন সরকার এবং তার চেলাচামুন্ডারা শুধু ওবিসি নয়, এস সি এস টি সবার সংরক্ষণ ব্যবস্থাটাই তুলে দিতে চায়। হাইকোর্টের রায় সেই লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদি গণআন্দোলন ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।
রাজ্যে ওবিসি আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী?
রাজ্য ওবিসি আন্দোলনের সম্ভাবনা ও সমস্যা দুটোই আছে। রাজ্যে মোট ওবিসি ৬৫ শতাংশ। মুসলিম ৩০ শতাংশ। অমুসলিম ওবিসি ৩৫ শতাংশ। তার মধ্যে মন্ডল কমিশন সুপারিশ করেছিল ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য। রাজ্যে এ পর্যন্ত সংরক্ষণ আছে ১৭ শতাংশ। তার মধ্যে ১০ শতাংশ হাইকোর্টের রায়ে ঝুলছে। রাজ্য ওবিসি সমাজের দায়িত্ব ছিল অন্তত ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা। আমরা তা করতে পারিনি। মুসলিম সমাজের দায়িত্ব ছিল রাজ্যের পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কে ওবিসি ঘোষণা করার আন্দোলন গড়ে তোলা। আমরা সেটাও ভাবিনি। ওবিসি সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে আন্দোলন করার আর্থ সামাজিক উপাদান ও উপকরণ রাজ্যে আছে। কিন্তু ওবিসি সমাজের অগ্ৰসর ও সচেতন অংশের মধ্যে সমাজের স্বার্থে কাজ করার মনোভাব কম থাকার কারণে তা হচ্ছে না। সব সময় কোন না কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকেই সুযোগ সুবিধা লাভ করতে চায়। এই সুবিধাবাদী মানসিকতাই ওবিসি সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে একটা বড় বাধা।
কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর সংখ্যালঘুরা কি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে?
সাধারণত মধ্যবিত্ত সমাজের স্বার্থে আঘাত না লাগলে বা ওই অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় না হলে মধ্যবিত্ত সমাজ নড়াচড়া করে না। চুপ থাকে। এটা সব সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ওবিসি সমাজের বিশেষ করে মুসলিম সমাজের উদীয়মান মধ্যবিত্ত অংশ সামগ্রিক মুসলিম সমাজের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সচেতনভাবে উদাসীন থাকে। ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিলের সাথে পড়াশোনা, গবেষণা, চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা, চাকুরী পাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেই সমাজের এই অংশ নড়াচড়া শুরু করেছেন। সেটাও আশানুরূপ নয়।
এই আন্দোলনে অমুসলিম ওবিসিদের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
অনেক আগে থেকেই ওবিসি সমাজের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস আছে। পাশাপাশি কিছু ব্যক্তি বিভেদ তৈরি করার চেষ্টাও করেন। বর্তমানে সংঘ পরিবারের দৌলতে এদের সংখ্যা বেড়েছে। সংঘ পরিবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে তার দ্বারা কিছু ওবিসি মানুষও প্রভাবিত হচ্ছেন। উভয় সম্প্রদায়ের ওবিসিদের মধ্যে যোগাযোগ, আলাপ আলোচনা, যৌথ কর্মসূচি বৃদ্ধি করলে এর সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর যৌথ কর্মসূচি চোখে পড়েনি। বরং কিছু ব্যক্তি আরএসএস এর হয়ে হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে ওকালতি করছে।
আপনি তো পশ্চিমবঙ্গ ওবিসি মঞ্চেরও সভাপতি। এই সংগঠনের ভূমিকা কী?
রাজ্যের মুসলিম অমুসলিম সমস্ত ওবিসি জনগোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় আনা এই সংগঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা হাইকোর্টের রায়ের বিরোধিতা করে বেশ কিছু কর্মসূচি নিয়েছি। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের ভূমিকারও সমালোচনা করেছি। এবং রাজ্য সরকারের ভূমিকা সন্তোষজনক নয় বলে মনে করি। ওবিসি সমাজ রাজনৈতিক ক্ষমতায় ভাগ বসাতে না পারলে এ সবের স্থায়ী সমাধান হবে না। যারা শীর্ষ আদালতে রাজ্য সরকারের মামলার সাথে যুক্ত হয়েছেন তারা শুধুমাত্র সার্টিফিকেট সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের সামনে কোন রাজনৈতিক দিশা নেই বলে মনে হচ্ছে।
আদালতের রায় বাদ দিলেও রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণের বাস্তবায়ন কোথায় দাঁড়িয়ে?
মোটেই না। কারণ বাস্তবায়ন করার চেয়ারে যারা বসে আছেন তাদের অধিকাংশটাই ওবিসি সমাজের বিরোধী। তারা কেউই ওবিসি সমাজের উন্নতি বা কল্যাণ চান না। প্রথম কথা এই রাজ্যে অন্ততপক্ষে ২৭ শতাংশ বেশি সংরক্ষণ থাকা দরকার। সেটা নেই। দ্বিতীয়তঃ ওবিসি আইনে ক্রিমি লেয়ার নিয়ম থাকার জন্য সব সময় উপযুক্ত সংখ্যক প্রার্থী পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী তৈরি করার কোন কর্মসূচি সরকারের নেই। সেই অপূর্ণ পদগুলিকে অসংরক্ষিত করে অ-ওবিসিদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয়তঃ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে রোস্টার ব্যবস্থা আছে সেটাকেও সব সময় মানছে না। প্রচুর ওবিসি পদ খালি পড়ে আছে। ফলে ওবিসি সমাজের সামনে অনেক কাজ আছে। অনেক দায়িত্ব আছে। ঐক্যবদ্ধ ভাবে লাগাতার আন্দোলন করে যেতে হবে। চেষ্টা করতে হবে রাজ্যে যতগুলি ওবিসি গোষ্ঠী আছে সকলকে একই প্লাটফর্মে আনা যায় কিনা। তা হলে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর আন্দোলন করার কাজটা সহজ হবে। চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে হবে বহুজন সমাজের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।
শীর্ষ আদালতে স্থগিতাদেশ পাওয়ার বিষয়ে কতটা আশাবাদী?
যারা এসএলপি করেছেন তাঁদের তিন জন আইনজীবীর কথা অনুযায়ী স্থগিতাদেশ পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনেকটাই নির্ভর করছে রাজ্য সরকারের ভূমিকা বা রাজ্য সরকার নিয়োজিত আইনজীবীদের ভূমিকার উপর।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct