জাফিরা হক, আপনজন: ‘উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা আইন ২০০৪’ কে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেওয়া এলাহাবাদ হাইকোর্টের ২২ মার্চের রায়কে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে আজ এই মামলার শুনানি শুরু হয়। এই বিষয়ে গত শুনানিতে আদালত মৌখিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী আইনগুলি কেবল এই যুক্তি দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতার লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না।
মঙ্গলবার প্রবীণ আইনজীবী মুকুল রোহতগি, যিনি আবেদনকারীদের পক্ষে যুক্তিতর্ক শুরু করেছিলেন, তিনি জানান যে সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ ২৮(১) অনুচ্ছেদের ব্যতিক্রম। সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় নির্দেশনা প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত কিন্তু কোনো এনডাওমেন্ট বা ট্রাস্টের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য হবে না। তাই সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ট্রাস্ট পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে ধর্মীয় নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধানের ২৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনও পড়ুয়া স্বেচ্ছায় ধর্মীয় শিক্ষা নিতে পারবেন।
আইনজীবী মুকুল রোহাতগি একটি জনস্বার্থ মামলায় হাইকোর্টের রায় দেওয়ার বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির পরিপন্থী, কারণ এটি সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সমান। তিনি বলেন, ‘শত শত মানুষ পড়াশোনা করছে। আপনি কাউকে জোর করতে পারেন না। এটা ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।
জবাবে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল- বেঁচে থাকা এবং বাঁচতে দেওয়া।
প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, গোটা আইনটি বাতিল করার অর্থ হল মাদ্রাসাগুলি অনিয়ন্ত্রিত থাকবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থেই কি আপনারা মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন না? ৭০০ বছরের ইতিহাস এভাবে মুছে ফেলা যায় না।
তিনি বলেন, স্বীকৃতির জন্য একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে একঘরে করা অসাংবিধানিক ছিল। আসুন আমরা ভারতকে সংস্কৃতি ও ধর্মের মেলবন্ধনের জায়গা হিসাবে সংরক্ষণ করি। ধর্মীয় নির্দেশনা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়। হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও এটা আছে। দেশটি সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং ধর্মের একটি মিলিত জায়গা হওয়া উচিত। আসুন আমরা এটাকে সেভাবেই সংরক্ষণ করি।
বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা অরুণা রায়ের রায় উল্লেখ করে বলেন, সংবিধানে ধর্ম শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়নি।
প্রধান বিচারপতি উত্তরপ্রদেশ সরকার পক্ষের অইনজীবী কৃষ্ণকুমারকে বলেন, “ধরুন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং রাষ্ট্র বলছে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রদান করুন। এটাই আমাদের দেশের নৈতিকতা। মনে রাখবেন, ইসলামের প্রেক্ষাপটে আপনি যা যুক্তি দিচ্ছেন তা বেদ পাঠশালা থেকে শুরু করে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, জৈন পুরোহিতদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ভারতের সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে ধর্মীয় নির্দেশনা কখনওই অভিশাপ নয়।
কৃষ্ণকুমার যখন বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মূলধারার শিক্ষার্থীদের সমতুল্য হতে সক্ষম করবে না, তখন বিচারপতি পারদিওয়ালা বলেন, আপনি কেন তাদের সমান হতে চান? আপনি তাদের সমতুল্য হতে বাধ্য করতে পারেন না!।
এই বিষয়ে এনসিপিসিআর-কে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন করে যে শুধু মাদ্রাসা নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন এনসিপিসিআর? এনসিপিসিআরের আইনজীবী স্বরূপমা চতুর্বেদী বলেন যে মাদ্রাসাগুলিকে মূলধারার শিক্ষার বিকল্প হিসাবে দেখা যায় না। মাদ্রাসা শিক্ষা যদি স্কুল শিক্ষার পরিপূরক হয় তাহলে এনসিপিসিআরের কোনও আপত্তি নেই, তবে এটি বিকল্প হতে পারে না। চতুর্বেদী জানায় এনসিপিসিআর মাদ্রাসা ব্যবস্থার ঘাটতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে এবং সেগুলি পরিদর্শন করার জন্য রাজ্যগুলিকে চিঠি দিয়েছে, তখন আদালত জিজ্ঞাসা করে যে এনসিপিসিআর অন্যান্য ধর্মের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও একই অবস্থান নিয়েছে কিনা।
প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, তাহলে বলুন তো, এনসিপিসিআর কি কোনও মঠ, পাঠশালায় শিশুদের পাঠাবে না বলে কোনও সম্প্রদায় জুড়ে একটি নির্দেশিকা জারি করেছে? এনসিপিসিআর কি কোনও নির্দেশিকা জারি করেছে যে যখন বাচ্চাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে পাঠানো হবে, তখন তাদের অবশ্যই বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি পড়াতে হবে? শুধু মাদ্রাসা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? আপনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছেন কিনা তা আমরা জানতে চাই। এনসিপিসিআর কি সব সম্প্রদায়ের প্রতি সমান আচরণ করেছে?
এনসিপিআর এর পক্ষে উপস্থিত আইনজীবী চতুর্বেদীকে বিচারপতি পারদিওয়ালা জিজ্ঞাসা করেন যে এনসিপিসিআর মাদ্রাসাগুলির পুরো পাঠ্যক্রম অধ্যয়ন করেছে কিনা। শীর্ষ আদালতের বেঞ্চ আবেদনকারীদের হয়ে সিনিয়র অ্যাডভোকেট এএম সিংভি, পি চিদম্বরম, সলমন খুরশিদ এবং এম আর শামশাদের বক্তব্য শোনে। সিংভি বলেন, এই আইনটি বাতিল করা মাদ্রাসাগুলিকে কার্যত নিষিদ্ধ করার সমান; মানদণ্ডে ঘাটতি থাকলে রাষ্ট্রের উচিত পুরো কাঠামো ভেঙে ফেলার পরিবর্তে আইনের অধীনে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের উন্নতি করা। তিনি আরও বলেন, মাদ্রাসায় সব আধুনিক বিষয় পড়ানো হয়। চিদাম্বরম পরামর্শ দেন, মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষকদের চাকরির শর্তগুলি অন্যান্য শিক্ষকদের মতো করা উচিত। শামশাদ এনসিপিসিআর-এর প্রতিবেদনের কিছু মন্তব্যকে ‘ইসলামোফোবিক’ আখ্যা দিয়ে আপত্তি জানান। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ২২ মার্চ উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা বোর্ডের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং সংখ্যালঘু কল্যাণ দফতরের মাদ্রাসা পরিচালনার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে দায়ের করা একটি রিট পিটিশনে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ‘উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা আইন ২০০৪’ কে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেয়।
বিচারপতি বিবেক চৌধুরি ও বিচারপতি সুভাষ বিদ্যার্থীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন উত্তরপ্রদেশ সরকারকে একটি প্রকল্প তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে যাতে বর্তমানে মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় জায়গা পেতে পারে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে অঞ্জুম কাদারি, ম্যানেজারস অ্যাসোসিয়েশন মাদারিস আরাবিয়া (ইউপি), অল ইন্ডিয়া টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন মাদারিস আরাবিয়া (নয়াদিল্লি), ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন আরবি মাদ্রাসা( নাই বাজার) এবং শিক্ষক সমিতি মাদারিস আরাবিয়া( কানপুর)হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পিটিশন দাখিল করে। আবেদনকারীদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী এ এম সিংভি, মুকুল রোহতগি, পি এস পাটওয়ালিয়া, পি চিদাম্বরম, মেনকা গুরুস্বামী, সালমান খুরশিদ, এম আর শামশাদ প্রমুখ আইনজীবী।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct