ড. রামিজ রাজা, আপনজন: হ ক সাহেবকে অকুণ্ঠ স্নেহ, উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়েছিলেন স্যার আশুতোষ, মহাত্মা অশ্বিনীকুমার এবং স্যার সলিমুল্লাহ। এই তিন মহামানবের স্নেহ, মমতা, সাহচর্য ও আশীর্বাদ লাভ করেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাংলার শার্দূল, অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক।
১. ১৯১৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারী ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন ভারতের সংবাদপত্রগুলোর কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যে ‘ভারতীয় প্রেস অ্যাক্ট’ নামক একটি কুখ্যাত আইন পাস করে। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৩২তম অধিবেশনে হকসাহেব এই আইনের বিরোধিতায় বজ্রকন্ঠে একটি গুরুগম্ভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “সম্মিলিত ভারতবর্ষের কোটি কোটি কন্ঠের বজ্র আওয়াজকে রুখতে পারে দুনিয়ার আজ পর্যন্ত তেমন কোন শক্তি জন্ম লাভ করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। নির্যাতন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা মানুষের স্বভাব। আমি আশা করছি ব্রিটিশ শাসকবর্গ সময় থাকতে সাবধান হবেন এবং অবিলম্বে আইনের পুস্তক থেকে এই দমন মূলক প্রেস অ্যাক্ট অপসারিত করবেন।”
২. ১৯১৮ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। এই আন্দোলনকে পদদলিত করার জন্য পাস করা হয় কুখ্যাত ‘রাওলাট অ্যাক্ট’। ১৯১৯ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি এই কুখ্যাত আইনের বিরুদ্ধে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক।
৩. ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এ. কে. ফজলুল হক, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, পন্ডিত মতিলাল নেহরু এবং বদরুদ্দীন তায়েবজীকে নিয়ে গঠিত হয় একটি উচ্চপর্যয়ের তদন্ত কমিটি। শেরে বাংলা ফজলুল হক ছিলেন যে কোন রকমের অন্যায় অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং যে কোন আন্দোলনের অগ্র নায়ক।
৪. ১৯২১ সালে কলকাতা পুলিশ কমিশনার স্যার রেজিনল্ড ক্লার্কের নির্দেশে নাখোদা মসজিদের সামনে আন্দোলনরত ব্রিটিশ বিরোধী মুসলমানদের সামনে মেশিন গান স্থাপন করা হলে শেরে বাংলা বাঘের গর্জনে বলেন, “আমাকে খুন না করে তোমরা অন্য কোন মুসলমানকে স্পর্শ করতে পারবে না।”
৫. ১৯৩০-৩১ সালে শেরেবাংলা লন্ডনে প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেন। কংগ্রেস এই বৈঠক বয়কট করে ফলে এই গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ঘটে। তিনি কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই বৈঠকে যান এবং ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, “আমাদের ধমনীতে গোলামের রক্ত প্রবাহিত হয় না।” শেরে বাংলার এই একটিমাত্র বক্তব্য থেকেই সেদিন বোঝা গেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মূল কথা।
৬. ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাট পঞ্চম জর্জের রজত জয়ন্তী। এই উপলক্ষে বাধ্যতামূলকভাবে উৎসব পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয় সারা ভারত জুড়ে। সকল ধর্মের মানুষদের সর্বত্র মসজিদ, মন্দির এবং গির্জায় সম্রাটের দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রার্থনা অনুষ্ঠান করতে আদেশ করা হয়। কিন্তু সেদিন সারা ভারতের মাত্র একটি মানুষই এই অন্যায় ও অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক এই আদেশের প্রতিবাদ জানিয়ে এক জনসভায় ঘোষণা করেন কোন মুসলিম তার মসজিদে কোনো বিধর্মীর জন্য প্রার্থনা করতে পারবেন না। শেরে বাংলার এই ডাকে সাড়া দিয়ে সারা ভারতের মুসলিমরা সেদিন একসঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং সারা ভারতবর্ষের কোনও মসজিদে ব্রিটিশ সম্রাটের জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়নি।
৭. ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনেরও প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন শেরে বাংলা। শুধু সমর্থন নয় তিনি শ্রদ্ধানন্দ পার্কে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা করা কালীন এই মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার আদেশ দেন।
৮. সুভাষ বসু ও শরৎ বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। ১৯৪১ সালে নেতাজি দেশ ত্যাগ করেন এবং এর পিছনে শেরে বাংলার পরোক্ষ হাত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজকে তিনি চুড়ান্তভাবে সমর্থন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
৯. ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও শেরে বাংলা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন।
১০. ১৯৪২ সালে হিন্দু বাঙালি যুবকদের উপর মেদিনীপুরে পুলিশি নির্যাতনের তদন্ত করতে উদ্যত হলে ইংরেজ গভর্নর হার্বার্টের সাথে তাঁর তীব্র মতবিরোধ হয়েছিল।
১১. ১৯৪৩ সালে জাপানি আক্রমণের আশঙ্কায় ভীত হয়ে ব্রিটিশ সরকার জাপানিদের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ‘পোড়ামাটির নীতি’ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যার ফলে ধান, চাল, নৌকা এবং যাবতীয় যানবাহন গঙ্গার এপারে কলকাতার পশ্চিমে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করে। ফজলুল হক দেখলেন ‘পোড়ামাটির নীতি’ কার্যকর করলে ব্রিটিশদের সুবিধা হলেও না খেতে পেয়ে বাংলার লাখ লাখ মানুষ মারা যাবেন। অতএব সরকারের সর্বনাশা পোড়ামাটি নীতির সঙ্গে শেরে বাংলা কিছুতেই একমাত্র হতে পারলেন না। ফলে গভর্নর হার্বার্টের সাথে তাঁর মতবিরোধ আরো তীব্র হল। পরাধীন আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও বড়লাটের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মন্ত্রী থাকা যায় না। অতএব পোড়ামাটির নীতি চালিয়ে লাখ লাখ বাঙালির প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করার চেয়ে শেরে বাংলা মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করা শ্রেয় মনে করলেন। অবশেষে ১৯৪৩ সালের ২৮ শে মার্চ তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়ার পর তিনি বাংলা তথা ভারতের ঐক্য বজায় রাখার আহবান জানিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন।
শেরে বাংলা ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। তিনি অত্যাচারী ইংরেজদের বিরোধিতা করে নিপীড়িত বঞ্চিত বাঙালিদের নানা অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের জন্য আজীবন লড়াই করেছিলেন। নিজের জীবনের কখনো পরোয়া করেননি। জীবন বাজি রেখে তিনি দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একদা এক ব্রিটিশ সিভিলিয়ান শেরে বাংলার কাজের সমালোচনা করলে অসম সাহসী শেরে বাংলা তাকে বলেছিলেন, “তোমার চরিত্র সংশোধন কর তা নাহলে তোমাকে তল্পিতল্পাসহ এদেশ থেকে বের করে দেবো।”
তথ্যসূত্র:
১. শেরে বাংলা, বি ডি হাবীবুল্লাহ
২. শের-ই-বাংলা আগুনপাখি, মৃণালকান্তি দাস
৩. বাংলার বাঘ এ.কে. ফজলুল হক, হেলাল উদ্দিন
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct