শহর কলকাতায় এখন মুসলমান সমাজের আধিপত্য আর অতীত দিনের মতো নেই। অথচ, শহর কলকাতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে রয়েছে মুসলমানদের পদচারণা। শহর কলকাতার উত্থানের সঙ্গে তাই মুসলমান ভাবানুষঙ্গ সম্পৃক্ত। কলকাতার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মশাল জ্বালানোর ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান আজ বিস্মৃতপ্রায়। নওয়াব যুগ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তীতে শহর কলকাতায় মুসলমানদের সেই অনালোকিত ইতিহাস রোমন্থন করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবেত্তা ও সমাজবিজ্ঞানী খাজিম আহমেদ।
অষ্টাদশ শতক থেকে ১৯ শতকের সিকি অংশ সময় পর্যন্ত সিলাই করা কাপড় পরিধানের বিষয়টি ছিল খুবই কম। ক্রমেই আর্চ বা খিলানযুক্ত বাড়ি ও সেলাই করা কাপড় পরিধানের অভ্যাস ক্রমেই জনপ্রিয় হতে থাকে। decent life-এর জন্য এগুলি বিশেষভাবে জরুরি ছিল। শিল্প সংক্রান্ত এই বিষয় দুটির কৃতিত্বের দাবি মুসলমানদেরই প্রাপ্য। সেই দর্জি শিল্প এখনও মুসলমান ওস্তাগররাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। যদিচ হালফিল উক্ত ব্যবসায় মারোয়াড়ী ও গুজরাটিরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আমরা মোগলাই খানার প্রসঙ্গে বিরিয়ানির কথা তুলেছিলাম। তখন বিরিয়ানি ছাড়াও হরেক কিসিমের মোগলাই খানা— যেমন সিক কাবাব, কাঠি কাবাব, বোটি কাবাব, সামি কাবাব, হাঁড়িয়া কাবাব, সুতলি কাবাব, টিকিয়া কাবাব, মাহি কাবাব, গলোটি কাবাব, আফগানি কাবাব, কিমা কাবাব, মুর্গা মুসাল্লাম, রেজালা, হাড়বিহীন মুর্গির কাবাব, হাড়বিহীন মাহি কাবাব, বেরেস্তাসহ মাটন-চাপ, ফিরনি, শাহি টুকরা, পোলাও, কোর্মা, রুমালি রুটি, তন্দুরি রুটি, মুর্গী তন্দুরি, মাহি পোলাও, শিরমল, শীতের সকালে নিহারি, তাহারি এবং রমজানের মাসে হালিমের স্বাদ বাঙালি রসনাকে তৃপ্ত করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ সকল সম্প্রদায়ই হালিমের স্বাদ পেতে উন্মুখ থাকে। এছাড়াও রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত হালুয়া আফলাতুন, মুসকত্ হালুয়া, মাসপতি হালুয়া ও অন্যান্য আরও হরেক রকমের হালুয়া, লাচ্ছা সেমাই, বালুশাহি, বাদশাহি রুটি, ভুনি-খিচুড়ি ইত্যাদি— এগুলি কলকাতার জনজীবনে মুসলমান কালচারের ধারাবাহিকতা বহন করে।
গঙ্গা নদীর (হুগলি নদী) পশ্চিম প্রান্ত থেকে আগণন জনমানুষ কালকাতায় ঢোকেন লেডি ব্রেবোর্ন রোড ধরে। যথার্থ আদি কলকাতা বলতে যে অঞ্চলগুলোকে চিহ্নিত করা হয় সেগুলো উল্লেখিত লেডি ব্রেবোর্ন রোডের পার্শ্ববর্তী পাঁচ-ছয় স্কোয়ার কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত এবং সেই অঞ্চলগুলো বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত, অবশ্য কিয়দ সংখ্যক পার্সি, ইহুদি, খ্রিস্টান সমাজের লোকেদের ও বসবাস ছিল। যদিও এই সংখ্যা ক্রম হ্রাসমান। অঞ্চলগুলো হল পোলক স্ট্রিট, মেটকাফ স্ট্রিট, জাকেরিয়া স্ট্রিট, ক্যানিং স্ট্রিট, কলুটোলা স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, ওল্ড চায়নাবাজার, বো-বারাক, ফিয়ার্স লেন, রতু সরকার লেন, বন্দুক গলি, ছাতাওয়ালা গলি, চিনেপাড়া, (Black burn) ব্ল্যাকবার্ন লেন, কবিরাজ রো ইত্যকার অঞ্চলগুলো মুসলিম অনুসঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা জানবাজারের কথা উল্লেখ করেছিলাম। সেই সুবাদেই গ্র্যান্ড স্ট্রিট, ধর্মতলার মোগলাইখানা ‘ইন্ডিয়ানা’, হাজিজ বিরিয়ানি চাঁদনিচকে এবং প্রিন্সেপ স্ট্রিটে প্রবাদতুল্য রিজালাখ্যাত সাবিরস রেস্তোরাঁ এবং অধুনালুপ্ত আমজাদিয়া হোটেল অঞ্চল মুসলিম আদব কায়দা অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট স্থিত ওরিয়েন্ট সিনেমার সন্নিকটে ‘আলিয়া’ নামক একটি মোগলাই রেস্টুরেন্টে অতিখ্যাত আফলাতুন হালুয়া উভয় বঙ্গেই অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ছিল। কলুটোলা অঞ্চলে ফিয়ার্স লেন ও রতু সরকার লেনের মধ্যস্থ স্থানে হাজি আলাউদ্দিনের মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানে আফলাতুন উপলব্ধ ছিল। হাজী আলাউদ্দিনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল— জ্বলন্ত উনুনে চাপানো বিশালাকার কড়াই ভর্তি গরম দুধ জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল লোকজন ক্রমাগত পান করে যেত। যেন বিভিন্ন ধর্মের মানুষের এক মহামিলন ক্ষেত্র। নাখোদা মসজিদের বিপরীতে রয়্যাল ইন্ডিয়া হোটেলের রুমালি রুটি ও মাটন চাপ হিন্দু মুসলিম সকল উপভোক্তাকেই আকৃষ্ট করত এবং এটা কলকাতার একটি ল্যান্ডমার্ক হিসাবে চিহ্নিত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য কলকাতার মুসলমানই রসুইখানার অতিপ্রসিদ্ধ ‘আমিনিয়া’, ‘নিজাম হোটেল’, কলকাতা জনজীবনের প্রাণকেন্দ্র এবং কর্পোরেশন ও নিউমার্কেট এলাকায় এই দুটি অবস্থিত।
কলকাতস্থিত বিশেষ কয়েকটি মসজিদ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে নাখোদা মসজিদের খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে উপমহাদেশব্যাপী। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি স্থাপিত হয়। এই ঐতিহাসিক মসজিদটির সঙ্গে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জড়িয়ে ছিলেন। এই মসজিদে জুম্মাবারে প্রায় পনেরো হাজার মানুষ নামাজ পড়তেন। ঈদের সময় এই সংখ্যা প্রায় তিরিশ হাজারে পৌঁছে যেত। স্বাধীনতা লাভের পরে প্রথম কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পিতা মওলানা খাইরুদ্দিন প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তিনিই সেখানে ইসলাম ধর্ম বিষয়ক আলোচনা ও নসিহত করতেন।
১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে অ্যাংলো-মাহিশুর যুদ্ধশেষে টিপু সুলতানের বংশধরকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে নির্বাসিত করে। টালিগঞ্জ, সেলিমপুর এলাকায় শহীদ টিপু সুলতানের বংশধরদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রিন্স আনোয়ার আলি শাহ্, টিপু সুলতানের প্রত্যক্ষ বংশধর। তাঁর নামেই দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত একটি অঞ্চল প্রিন্স আনোয়ার আলি শাহ্ রোড নামে অতি পরিচিত। টিপু সুলতানের সর্বশেষ পুত্র প্রিন্স গোলাম মুহাম্মদ শাহের নামে রাস্তা বহাল রয়েছে আজও। প্রিন্স মহম্মদ কলকাতার ল্যান্ডমার্ক হিসাবে পরিচিত ধর্মতলায় শাহী টিপু সুলতান মসজিদ এবং টালিগঞ্জে নির্মাণ করেছিলেন শহীদ টিপু সুলতান মসজিদ। পি.টি. নায়ার “South-Indian in calcutta” (সাউথ-ইন্ডিয়ান ইন ক্যালকাটা, 2004), নামক গ্রন্থে হায়দর আলির উৎপত্তি থেকে টিপু সুলতানের বংশলতিকা অতি-যত্নে সংগ্রহ করে মুদ্রিত করেছেন। টিপু সুলতানের শহীদত্বের পর যাদের ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কলকাতায় নিয়ে এসেছিল তাদের চমৎকার পরিচিতি এই গ্রন্থটিতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ পরিবার টিপু সুলতানের প্রত্যক্ষ এবং পরবর্তী বংশধরদের বাড়িতে সৌজন্যসূচক যাতায়াত ছিল। ব্রিটিশ অভিজাত মহিলারা টিপুর পরিবারের বেগমদের অভিজাত আচরণের তারিফদার ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, টিপু সুলতানের নাতনির বিবাহ সুলতান পরিবারের একজন যোগ্য ছেলের সাথে কলকাতাতেই হয়েছিল। তাঁরা স্বামী স্ত্রী কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির পরিচালনায় অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি নাতনির স্বামী মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। টিপু সুলতানের সেই নাতনির নামে আজও একটি রাস্তার নাম আজও বিদ্যমান। সেটি হচ্ছে আঞ্জুমান-আরা রো (Row)। পুরো নাম বেগম আঞ্জুমান আরা সুলতানা। এমনবিধ ঐতিহাসিক বিষয় কলকাতায় মুসলমান সংযোগের নজির হিসাবে আজও বিদ্যমান।
ব্রেবোর্ন রোডে সাইফি মসজিদ (১৯২১) কলকাতার ‘দাউদি বোহরা’ বা ‘তায়েবি মুসলমানদের’ প্রার্থনা কেন্দ্র শুধুমাত্র প্রার্থনার জন্যই নির্মিত হয়নি, শিক্ষাদীক্ষা, সমাজসেবা, দীন-দুঃখদের সেবার কেন্দ্র হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুজরাতের আদি বাসিন্দা। বস্ত্র ব্যবসায়ী হিসাবে এই উপমহাদেশে নামের খ্যাতি রয়েছে। চৌরঙ্গীতে জে.এস. মহম্মদ আলি, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে মহম্মদ আলি গোলাম আলি, গ্র্যান্ড স্ট্রীটে এ. মহম্মদ আলি, গ্রান্ড হোটেলের উত্তরাংশে রক্সি সিনেমার দক্ষিণাংশে এবং পার্ক স্ট্রিটে বরকত আলি অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রমুখ অতি খ্যাতিমান পরিবার ছিল। কেরালা বা মাদ্রাজি মুসলমানদের কলকাতার আধুনিকীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। গ্র্যান্ড স্ট্রিটের পি. পি. হাসান (P. P. Hasan) একদা কলকাতায় কেরালার মুসলমানদের প্রতিনিধি স্থানীয় ছিলেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজের পার্শ্ববর্তী ভবানী দত্ত লেনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উর্দুভাষী মুসলমানরা বিশেষ একটি সাংস্কৃতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেটি হল— বিভিন্ন নামের ব্যান্ড বাজনাদার বা তাশা পার্টিমূলক সংস্কৃতি। ঠিক এর পাশেই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে রয়েছে মুহাম্মদ আলি পার্ক। খিলাফত আন্দোলনের একজন অতি মান্য নেতা হিসাবে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তিনি পরিচিত ছিলেন। এই উদ্যানটি এমন অঞ্চলে অবস্থিত, যে অঞ্চলটি বিভিন্ন ধর্মীয় মানুষের মহামিলনক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত। Calcutta Medical College-এর অভ্যন্তরে অবস্থিত মসজিদ, ৮ নম্বর স্মিথ্ লেনে অবস্থিত ইলিয়ট হোস্টেলের মসজিদ, কারমাইকেল হোস্টেল মসজিদ, বেকার হোস্টেল মসজিদ, এইসব মসজিদগুলিতে (A.K. Fajlul Haque) এ. কে. ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দির মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা বহুসময় তাঁদের নামাজ আদায় করেছেন।
বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেল, মুসলিম ইনস্টিটিউট, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, শাখোয়াত হোসেন গার্লস হাইস্কুল, ইসলামিয়া কলেজ (১৯২৩) [সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ (১৯৪৮), মৌলানা আজাদ কলেজ (১৯৫৬)], ইসলামিয়া হাসপাতাল ইত্যকার প্রতিষ্ঠানগুলো সাবেক বাংলার মুসলমানদের জীবন বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।
বিশেষ কয়েকজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গ অবশ্যই উত্থাপিত হওয়া দরকার। এঁরা প্রত্যেকেই অভিজাত প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। যেমন জাস্টিস সৈয়দ আমির আলি, স্যার আজিজুল হক, এ. কে. ফজলুল হক, আবুল হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, এস. এ. মাসুদ এবং এ. ডব্লিউ. মাহমুদ। কলকাতায় মুসলমানদের অবস্থানকে এঁরা মর্যাদাপূর্ণ করে তুলেছিলেন।
নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলি, মওলানা আকরম খাঁ, মৌলভী মুজিবুর রহমান, এ. কে. এম. জাকারিয়া, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, দার্শনিক-পণ্ডিত হুমায়ুন কবির, ড. মেহেদী হাসান, ডা. আর. আহমেদ এবং আবদুল আজীজ আল্-আমান কলকাতায় মুসলিম ভাবাশ্রয়ী যাপননামার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
(সমাপ্ত)
অনুলিখন : সাবিনা সৈয়দ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct