ভারতের দলিত, মুসলিম এবং পিছিয়ে পড়া জনজাতি (ওবিসি) বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে যুগ যুগ ধরে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা সংগঠন গড়ে উঠেছে। তবে, দুঃখজনকভাবে, এই সংগঠনগুলো প্রায়শই স্থায়িত্ব বজায় রাখতে পারেনি এবং তাদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। লিখেছেন পাশারুল আলম...
ভারতের দলিত, মুসলিম এবং পিছিয়ে পড়া জনজাতি (ওবিসি) বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে যুগ যুগ ধরে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা সংগঠন গড়ে উঠেছে। তবে, দুঃখজনকভাবে, এই সংগঠনগুলো প্রায়শই স্থায়িত্ব বজায় রাখতে পারেনি এবং তাদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আজ এই প্রবন্ধে আমরা এই সংগঠনগুলোর গঠন, কাজের পদ্ধতি, এবং তাদের সংকট নিয়ে আলোচনা করবো।
সংগঠন গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য
দলিত, মুসলিম ও পিছিয়ে পড়া জনজাতির অধিকার রক্ষা, সামাজিক উন্নতি এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য প্রথমদিকে এই সংগঠনগুলোর গঠন করা হয়েছিল। নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব এবং নিপীড়িতদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। সমাজে বিদ্যমান অন্যায়, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে এবং সেই শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এই সংগঠনগুলির প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য।
নেতৃত্বের সংকট ও বিভাজন
যে উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা নিয়ে এই সংগঠনগুলি তৈরী হয়, সময়ের সাথে সাথে এই সংগঠনগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের লড়াই ও আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা দিতে শুরু করে। বিভিন্ন নেতা নিজেদের অবস্থান ও ক্ষমতা ধরে রাখতে সংগঠনগুলিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলে। ফলে সংগঠনগুলো একক ব্যক্তি বা নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সেই ব্যক্তি যখন সরে যান বা মারা যান, তখন সংগঠনটি ভেঙে পড়ে। নতুন নেতৃত্বের অভাবে সংগঠনের উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। এই অন্তকলহে বিভিন্ন উপ-দল গড়ে ওঠে। একের পর এক বিভাজন এবং মনোমালিন্যর কারণে সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে লড়াই করতে ব্যর্থ হয়।
একতা ও সচেতনতার অভাব
এই সমস্যার প্রধান কারণ হল একতা এবং উদারতার অভাব। একজন নেতা অন্য নেতাকে মেনে নিতে পারেন না, ফলে দলগুলোর মধ্যে বিবাদ বাড়ে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম না করতে পারার ফলে শোষিত ও বঞ্চিত মানুষগুলোর উন্নতি সম্ভব হয় না। প্রতিটি নেতার মনে থাকে ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতার মোহ, যা তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। ঐক্যবদ্ধ না হতে পারার কারণে তাদের সংগ্রাম অনেক সময় অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই ভাবে একই ইস্যুতে বিভিন্ন সংগঠন ছন্নছাড়া হয়ে আন্দোলন সংগঠিত করে থাকে কিন্তু মিলিতভাবে একই দাবিতে একত্রিত হতে পারে না। কেউ একটু অধিক সক্রিয় হলে আর একটি সংগঠন অতি সক্রিয় হয়ে পড়ে। একটি সংগঠন আন্দোলন না করলে আর একটি সংগঠন চুপ থাকে। এই ভাবে মূল জায়গা থেকে সরে দাঁড়ায়। এই রোগে আক্রান্তের ফলে সবাই মিলিত হয়ে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো, সবাই যৌথ উদ্যোগের কথা বলে কিন্তু কেউ এই উদ্দেশ্যে একত্রিত করার চেষ্টা করলে পদের জন্য মন কষাকষি করে আর একজন দুরত্ব বজায় রাখে।
শিক্ষার অভাব ও মধ্যবিত্ত সমাজের ভূমিকা
এই বিভাজনের মূল কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষার অভাব এবং সচেতনতার ঘাটতি। যখন নেতৃত্ব বা সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা কম থাকে, তখন তারা সহজেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ছদ্মবেশী মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু মানুষের লোভ ও লালসা এখানে বড় ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্ব নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এবং তাদের লোভের কারণে সংগঠনগুলোর মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটে। এটা প্রথম বা দ্বিতীয় মধ্যবিত্ত প্রজন্মের কারনে হয়ে থাকে। সদ্য উঠে আসা মানুষজন এক প্রজন্মে অনেক কিছু পেতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখে সামাজিক সংগঠনকে বিচার করে নিজেকে জাহির করার একটি প্রবণতা প্রায় সব নেতৃত্বের মানসিকতায় ধরা পড়ে। এর ফলে একটি অহং বোধ বিকাশ লাভ করে থাকে। এই অহংবোধ তাকে অহংকারী করে তুলে। সাধারণ মানুষ যখন তা বুঝতে পারে তখন দূরে সরে যায়। এইভাবে জনশূন্য সংগঠনের অপমৃত্যু ঘটে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই সংকট কাটিয়ে উঠতে গেলে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো শিক্ষার প্রসার ও রাজনৈতিক সচেতনতার বৃদ্ধি। সংগঠনগুলোর নেতাদের একত্রিত হয়ে, নেতৃত্বের অহংকার ত্যাগ করে কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে। যাতে তারা ভবিষ্যতে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব দিতে পারে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে দলকেন্দ্রিক বা আদর্শকেন্দ্রিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। সংগঠন সংবিধান যেমন থাকা জরুরী তেমনি ব্যক্তিবাদকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশ থাকা আবশ্যক। একই ব্যক্তি একই পদে বার বার না রাখায় বাঞ্ছনীয়। সামাজিক সংগঠনের কোনো নেতৃত্ব যদি সংগঠনের মধ্যে কিংবা সামাজিক ক্ষেত্রে অসৎ হিসাবে প্রমাণিত হয় এবং আত্ম ত্যাগের প্রবনতা লোভ পায়, তাহলে সেই নেতৃত্ব পরিবর্তন করা জরুরী। অসৎ মানুষদের উচিত সেই দলে থাকা যেখানে অসৎ উপায়ে উপার্জন করা সম্ভব। সামাজিক সংগঠন করে সমস্ত সমাজকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার বা সমাজকে ব্যবহার করার প্রবনতা থেকে মুক্ত করার জন্য সাংগঠনিক পরিকাঠামো নির্মাণ করা আবশ্যক। প্রায় সামাজিক সংগঠনগুলিতে তেমন পরিকাঠামো থাকেনা। বহু সামাজিক সংগঠন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেরাই নেতা হয়ে বসে থাকে। এই নেতাতন্ত্র সামাজিক সংগঠনের জন্য একটি ভয়ংকর অসুখ। এই অসুখ থেকে নিরাময় পাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়।
পরিশেষে বলা যায়, দলিত, মুসলিম এবং পিছিয়ে পড়া জনজাতির মধ্যে নানা সংগঠন গড়ে উঠলেও, ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার কারণে তারা প্রায়ই বিফল হয়। এই সংগঠনগুলোর মধ্যে একতা ও উদারতার অভাব, শিক্ষার অভাব এবং স্বার্থপর নেতৃত্বের কারণে তারা বারবার ভেঙে পড়ে। যদি এই সমস্যাগুলো সমাধান করা যায় এবং সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দলমুখী ও আদর্শমুখী হতে পারে, তবে একদিন তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct