আপনজন ডেস্ক: রতন টাটা— দেশেন বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা সন্সের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান। মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার তিনি মারা যান। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। ধনকুবের হলেও জনহিতৈষী ব্যক্তি হিসেবে রতন টাটার খ্যাতি ও সম্মান ভারতজোড়া। ভারতের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় তাঁর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। অকৃতদার ও লাজুক স্বভাবের রতন টাটা আন্তর্জাতিক মহলে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভারতীয় ব্যবসায়িক নেতাদের একজন। দুই দশকের বেশি সময় টাটা শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালে ৭৫ বছর বয়সে অবসর নেন রতন টাটা।
রতন টাটা স্বনামধন্য শিল্পপতি। দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন টাটা শিল্পগোষ্ঠীকে। এত দিনে সমালোচনা ও বিতর্ক তাঁকে খুব কমই স্পর্শ করেছে। ব্যবসায়িক দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মক্ষেত্রে বলিষ্ঠ নীতির জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন।
রতন টাটা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই টাটা শিল্পগোষ্ঠীর রাজস্বের পরিমাণ বহু গুণ বেড়ে ২০১১-১২ সালে ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
শুরু ও সাফল্য
দেশের বিখ্যাত টাটা পরিবারে ১৯৩৭ সালে রতন টাটার জন্ম। শৈশবে পারিবারিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। রতন টাটার বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। রতন টাটা বেড়ে ওঠেন দাদির কাছে। যদিও এই পরিস্থিতি তাঁকে ধীরস্থির হতে এবং পারিবারিক মূল্যবোধের গভীরতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে বেশ সহায়তা করেছিল।
অতি ধনী পরিবারের বিলাসবহুল বাড়িতে বেড়ে ওঠা রতন টাটার। পড়াশোনা করেছেন স্থাপত্য ও কাঠামোগত প্রকৌশল নিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। হার্ভার্ডে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এরপরও বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান আইবিএমে চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সময়টা ১৯৬২ সাল। টেলকোতে (এখন টাটা মোটরস) কাজ শুরু করেন রতন টাটা। এই শিল্পগোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি কাজ করার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ১৯৭১ সালে ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেকট্রনিকসের পরিচালক হন তিনি। শিক্ষানবিশ থেকে পরিচালক—বন্ধুর এ যাত্রা রতন টাটা সফলতার সঙ্গে পার হন মাত্র ৯ বছরে। তবে কখনোই কঠোর পরিশ্রম, বাস্তবতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেননি। নিজেকে ক্রমাগত দক্ষ ও অভিজ্ঞ করে তুলেছেন। সেই সঙ্গে কাজের জায়গায় উন্নতি করেছেন।
ভারতের যে প্রান্তেই যান না কেন, একটি ব্র্যান্ড সবখানে চোখে পড়বে। সেটি টাটা। এমনকি ভারতজুড়ে এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি টাটার কোনো পণ্য ব্যবহার করেননি। টাটার সেবা নেননি। লবণ থেকে ইস্পাত, মোটর—টাটা খুঁজে পাবেন সবখানেই। বলা যায়, টাটা হলো ভারতে সবখানে ছড়িয়ে পড়া ব্র্যান্ড।
তবে এ যাত্রা সহজ ছিল না। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টাটাকে এগিয়ে নিতে রতন টাটা বড় ধরনের সাহস দেখিয়েছেন। যদিও বড় ধরনের অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সীমিত রেখেছিলেন রতন টাটা।
১৯৯১ সাল, রতন টাটা একাধারে টাটা সন্স ও টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। তিনি এমন এক সময়ে টাটা শিল্পগোষ্ঠীতে পুনর্গঠন শুরু করেন, যখন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হাঁটছিল।
তাঁর হাত ধরে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। একই সময়ে বিশ্বায়নের গতিধারাকে নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজে লাগিয়েছেন তিনি। নতুন শতকের শুরু থেকে টাটা শিল্পগোষ্ঠী বড় অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে। এর মধ্যে ৪৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারে টেটলি, ১ হাজার ১৩০ কোটি ডলারে কোরাস, ২৩০ কোটি ডলারে জাগুয়ার ল্যান্ডরোভার, বার্নার মন্ড, জেনারেল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্টস এবং ১০ কোটি ২০ লাখ ডলারে দাইয়ু অধিগ্রহণের ঘটনাও রয়েছে।
এসব কার্যক্রম রতন টাটার হাত ধরে এই শিল্পগোষ্ঠীকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অনেকটাই এগিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে পরিধি বাড়তে বাড়তে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে শতাধিক দেশে। ভারতের শিল্প খাতে তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ ঘটায় টাটা। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে টাটাকে বৈশ্বিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কৃতিত্ব অনেকটাই রতন টাটার।
রতন টাটা বিশ্বজুড়ে হোটেল, রাসায়নিক প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং জ্বালানি সরবরাহ খাতে ব্যবসা বাড়ান।
একপর্যায়ে রতন টাটা এয়ার ইন্ডিয়া কিনে নেন। মূলত এ উদ্যোগকে পূর্বপুরুষদের সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। কেননা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩২ সালে রতন টাটার চাচা ও পরামর্শদাতা জেআরডি টাটার হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
ব্যবসার মধ্য দিয়ে লাভ করার চেয়েও বাড়তি কিছু ভাবতেন রতন টাটা। তিনি নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। ২০২১ সালে আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া রিচ তালিকায় রতন টাটা ৪৩৩তম অবস্থানে ছিলেন। সম্পদের অনেকটাই দাতব্য কাজে দান করেছেন।
রতন টাটার হাত ধরে এগিয়ে চলা টাটা ট্রাস্ট ভারতের অন্যতম বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠানের একটি। প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং টেকসই জীবনযাপন খাতের প্রকল্পে সহায়তা করা হয় টাটা ট্রাস্ট থেকে। করোনা মহামারির সময়ও ৫০০ কোটি রুপি দান করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন রতন টাটা।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে একটি নির্বাহী কেন্দ্র গড়ে তুলতে পাঁচ কোটি ডলার দান করেছিলেন রতন টাটা। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়েছে টাটা ট্রাস্ট। মুম্বাইয়ে প্রাণঘাতী ২৬/১১ হামলার পর রতন টাটা ‘তাজ পাবলিক সার্ভিস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ একটি তহবিল গঠন করেন। এই তহবিলের অর্থ হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনে ব্যয় করা হয়।
জীবনভর এমনই নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন এই ধনকুবের। স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০০০ সালে ভারত সরকার রতন টাটাকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ২০০৮ সালে পান পদ্মবিভূষণ। দুটিই ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকের তালিকায় রয়েছে।
ভারত ও ভারতের বাইরের বহু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানজনক ডিগ্রি দিয়েছে। তবে রতন টাটা তাঁর দীর্ঘ জীবনে যেটা সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন, তা হলো মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct