আপনজন ডেস্ক: ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা নিয়ে গত ৭৫ বছর ধরে পশ্চিমা মিডিয়ার দ্বিচারিতা এবং ইসরায়েলের মিথ্যাচারিতার প্রভাব বিশেষজ্ঞদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বিশ্বব্যাপী এই অঞ্চলের পরিস্থিতি যেভাবে তুলে ধরা হয়, তা শুধুই ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান প্রকাশ করে। ফিলিস্তিনিদের মানবিক বিপর্যয়কে আড়াল করে এই ঘটনাগুলোকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ প্রায় ৫০ বছর আগে বলেছিলেন, ‘আপনি অন্য কাউকে নির্যাতন করতে পারেন না শুধু এজন্য যে একসময় আপনিও নির্যাতিত ছিলেন। এর একটি সীমা থাকা উচিত।’ কিন্তু সেই সীমা বহু আগেই অতিক্রম করেছে ইসরায়েলের মিথ্যাচারিতা। ইসরায়েলের সহিংসতাকে পশ্চিমা মিডিয়া বৈধতা দেয়। ক্রমশ তা মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। ২০২৩ সালে হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের কফার আজা কিব্বুৎসে ৪০টি শিশুর শিরচ্ছেদের খবর মিথ্যা ছিল। তবু তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এটিকে সত্য বলে দাবি করেছিলেন। যদিও পরে তিনি তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি পশ্চিমা নেতৃত্বের গাজা নিয়ে প্রচলিত মিথ্যাচারের একটি অংশ। অথচ গাজার রাফাহতে সন্তানের মাথাহনী দেহ ধরে থাকা একজন পিতার ঘটনাটি কোনও পশ্চিমা মিডিয়ায় শিরোনাম হয়নি। পশ্চিমা মিডিয়া যেনও ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের মানবিক বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে।যুক্তরাষ্ট্রের আইন অধ্যাপক খালেদ বেইডুন এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, যেখানে ইসরায়েলের শিশুদের মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা সংবাদ গৌরবের সঙ্গে প্রচারিত হয়, সেখানে ফিলিস্তিনের শিশুদের প্রকৃত মৃত্যু কোনও গুরুত্ব পায় না। ইউনিসেফ ২০২৩ সালে জানিয়েছিল যে, ইসরায়েলের আক্রমণে কমপক্ষে ১৩ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনা কখনোই বড় শিরোনামে আসে না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এক হাজার ১০০ সংবাদ নিবন্ধের মধ্যে মাত্র দুটিতে ফিলিস্তিনি শিশুদের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনে শিশুদের ক্রমাগত মৃত্যুর কথা কোনও আলোচনায় স্থান পায় না।এডওয়ার্ড সাঈদের লেখা ১৯৭৫ সালের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর এই ধারাবাহিক মানবিক অপমানের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আরবদের সবসময় জনসমষ্টি হিসেবে দেখানো হয়, যাদের কোনও ব্যক্তিত্ব নেই। এই চিত্র থেকে মনে হয় আরবরা সবসময় এক অন্ধকারময় ভবিষ্যতের হুমকি।’ যুক্তরাজ্যের ডেটা সাংবাদিক মোনা চালাবি পশ্চিমা মিডিয়ায় ফিলিস্তিনিদের উপস্থাপনায় এই বৈষম্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ইসরায়েলি মৃত্যু যখন মানবিকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়, তখন ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকে প্রতিশোধের প্রসঙ্গে উপস্থাপন করা হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ইসরায়েলি ভুক্তভোগীদের সবসময় ভালোবাসা ও পরিচয়সহ তুলে ধরা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের মৃত্যু পরেও শেকড়হীন।’ বিশেষ করে বিবিসি নিউজে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে ভাষাগত পার্থক্য প্রমাণ করে কীভাবে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে হামাসের লড়াইকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের মানবিক বিপর্যয়কে ‘দুঃখজনক ভুল’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইন্টারসেপ্টের এক গবেষণা দেখিয়েছে, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ইসরায়েলিদের নাম বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ডের বিপুল পরিসংখ্যান থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রবল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা এই দ্বন্দ্বে নতুন প্রজন্ম এখন অনেক বেশি সচেতন ও সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভগুলো পশ্চিমা মিডিয়াতে ‘হুমকি’ হিসেবে তুলে ধরা হলেও শিক্ষার্থীরা নিরলসভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা পশ্চিমা মিডিয়ার এই দ্বিচারিতা ও ইসরায়েলপন্থি মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বাইডেনের ৫০ শতাংশ ভোটার মনে করেন যে, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, ইসরায়েলের আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব তাদের নিজেরই একটি ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তার লেখায় ইসরায়েলি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান মিথ্যার পর্দা উন্মোচন করেছেন এবং এই বিপজ্জনক প্রবণতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাঈদের ভাবনা অনুযায়ী, এই মিথ্যার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সমাজ একদিন নিজেদের করুণ পরিণতি অনুভব করবে।ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় লিখতে হবে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের প্রেক্ষাপটে, যেখানে ফিলিস্তিনি মানবিকতা ও অধিকারের চেয়ে মিডিয়ার দ্বিচারিতা এবং ইসরায়েলের মিথ্যাচারিতাই কেন্দ্রে থাকবে। তবে, একটি প্রজন্ম এই অসম যুদ্ধের গল্পটিকে পাল্টানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct