নিজস্ব প্রতিবেদক, কলকাতা, আপনজন: রাজ্যের শীর্ষ বেসরকারি সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল আমীন মিশনে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হল রবিবার। আল আমীন মিশন সূত্রে জানা গেছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ৭২টি পরীক্ষা কেন্দ্রে এই প্রবেশিকা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নেয়।
আল আমীন মিশন সূত্র জানিয়েছে, রাজ্যের এক উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক অভিভাবক তার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে আল-আমীন মিশনে ভর্তি করার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে পড়েন। সারা বছর ধরে তাই অভিবাবকরা অপেক্ষা করে থাকে প্রবেশিকা পরীক্ষার দিনের জন্য। সেই প্রতীক্ষার অবশেষে অবসান হল রবিবার। এ ব্যাপারে মুর্শিদাবাদের এক পরীক্ষাকেন্দ্রের একজন অভিভাবক যিনি পেশায় হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক তিনি জানান, এলাকায় বিজ্ঞান বিভাগের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থাকলেও টিউশন পড়ার জন্যে মেয়েকে আরও বেশ খানিকটা দূরে যেতে হবে। সেকারণে তিনি ও তার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সন্তানকে আল-আমীনে ভর্তি করবেন। তাদের লক্ষ্য আল-আমীনে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মধ্যমিকের পর রসায়ন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন। তিনি আরও বলেন, আমরা জানি মিশনে পঞ্চম শ্রেণি থেকেই বিজ্ঞানের সমস্ত বিষয়ের গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এর ফলে বহু গ্রামীণ পরিবারের ছেলেমেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানভীতি কেটে যাচ্ছে। তারা উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভালো ফলও করছে। পাশে দাঁড়ানো অন্য অভিভাবক ও অভিভাবিকাগণও শিক্ষকের ওই কথায় সায় দিলেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার এক পরীক্ষাকেন্দ্রে একজন অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ হয়। জানলাম তিনি এক মসজিদে ইমামতি করেন। সামান্য আয়েই চলে সংসার। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের কাছ থেকে নামধাম ও কোন শ্রেণিতে পড়ে জানলাম। গ্রামের নিকটবর্তী একটি হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে সে। তার এক আত্ময়ীর কাছে সে শুনেছে মিশনে পড়লে মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট হয়। ইমাম সাহেবও বললেন, তাঁরও ইচ্ছে ছেলেকে আল-আমীনে পড়াবার। কারণ ওই স্কুলের রেজাল্ট খুব ভালো এবং সেখানে ইসলামি পরিমণ্ডলেও থাকা যায়। খরচাপাতির কথা জিজ্ঞাসা করলে, তিনি জানান শুনেছি ইমামদের ছেলে-মেয়েদের জন্যে মিশনের সেক্রেটারি স্যার বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকেন। এছাড়া ছেলের মামাও কিছুটা সহায়তা করবেন বলে সাহস করে পরীক্ষায় বসাতে ছেলেকে এনেছি।
সংখ্যালঘু সমাজের সফল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী গত কয়েক দশকে বেড়েছে। এর পিছনে রয়েছে আবাসিক শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত আল-আমীনের বিশেষ অবদান। চার দশক ধরে সংখ্যালঘু সমাজের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অতুলনীয় রেজাল্ট রাজ্যজুড়ে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে দিন দিন মিশনের প্রবেশিকা পরীক্ষার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ক্লাসরুম ও হস্টেলে স্থান সংকুলানের অভাবেই বহু মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর মিশনে পড়াশোনা সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে জানালেন মিশন কতৃপক্ষ। যদিও ১৯৮৭ সালের মাত্র ৭ জন আবাসিক পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজারের অধিক হয়েছে। প্রাক্তনীর সংখ্যা চল্লিশ হাজারের অধিক।
এবছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩০১৮১ জন। পরীক্ষায় বসেছে ২৯১৮৮ জন ছাত্রছাত্রী (ছাত্র ১৬৮৬৩ এবং ছাত্রী ১২৩২৫)। পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল ৭২ টি। মুর্শিদাবাদ, মালদহ-সহ আরও দু-একটি জেলার কয়েকটি পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হাজারের অধিক এবং কয়েকটি কেন্দ্রে হাজারের কাছাকাছি ছিল। আল-আমীনের নিজস্ব ৩৭ টি শাখা ছাড়াও মিশনের সহযোগী শিক্ষালয়ের ৩-টি অর্থাৎ মোট ৪০-টি আবাসিক প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে পরীক্ষার্থীরা। মিশনের সর্ববৃহৎ এই প্রবেশিকা পরীক্ষা ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে ইংরেজি মাধ্যমের পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের একাদশ (বিজ্ঞান) শ্রেণি, নিট (ইউজি), ইঞ্জিনিয়ারিং, ডব্লিউবিসিএস প্রভৃতির প্রবেশিকা পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়। এবছর ইংরেজি মাধ্যমের জন্য ফর্ম দেওয়া শুরু হবে ২০ নভেম্বর থেকে।
প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর হাতে এবছর আল-আমীনের তরফে সদ্য প্রকাশিত ‘আল-আমীন বার্তা’ তুলে দেওয়া হল। নিট (ইউজি), জেইই (মেইন ও আডভান্স), ডব্লিউবি জেইই-এর পাশাপাশি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও সিবিএসই (দশম ও দ্বাদশ) পরীক্ষায় মিশনের ছাত্র-ছাত্রীদের অতুলনীয় সাফল্যের কাহিনী পত্রিকায় সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামীণ পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়ের পরিশ্রম ও মিশনের পড়াশোনার প্রক্রিয়া পাঠের মাধ্যমে পড়ুয়ারা উৎসাহিত ও উজ্জীবিত হওয়ার পাশাপাশি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজেদের অদম্য লড়াই বজায় রাখতে সক্ষম হবে। এতো বড়ো পরীক্ষার আয়োজন ও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্যে আল-আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম অ্যাডমিশন টেস্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট মিশনের পুরো টিমকে মুবারকবাদ জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি সমস্ত অভিভাবক অভিভাবিকাদের সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মিশন শুরু থেকেই মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার অকালপতন রোধে সক্রিয়। আর্থিক প্রশ্নে সব সময়ই দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে আমরা থাকি কিন্তু মেরিট নিয়ে মিশনের নীতি বরাবরই অনমনীয়। কারণ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় যুগে মেরিটের সঠিক অনুশীলন বিনা সাফল্য অসম্ভব। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন যে, এতিম ও ইমাম সাহেবদের সন্তানদের জন্যে আমরা সহানুভূতিশীল হয়ে থাকি। এই ভাবনা থেকে এতিমদের বিশেষ পর্যবেক্ষণসহ পাঠদানের উদ্দেশ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতেই ভর্তি করা হচ্ছে। প্রায় ৫০ জন এতিম ও দুঃস্থ আবাসিক ছাত্র-ছাত্রী মিশনের ‘শান্তিনীড়’-এ ইতিমধ্যেই পড়াশোনা করছে। এবছর শান্তিনীড়ে ভর্তির জন্যে ফর্ম দেওয়া হবে ৩১ অক্টোবর থেকে। আজকের এই শুভক্ষণে তিনি আরও বলেন, নিউটাউনে নির্মাণাধীন আল-আমীন মিশন ইন্সটিটিউট ফর এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এ ৭ জুলাই থেকে নিট (ইউ জি)-এর আবসিক কোচিং শুরু হয়েছে। এমাসের প্রথম দিকেই শুরু হতে যাচ্ছে নবপর্যায়ের ডব্লিউ.বি.সি.এস. কোচিংয়ের ব্যবস্থাও।উল্লেখ্য, মাধ্যমিক পর্যায়ের এই প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে ৩১ অক্টোবর ২০২৪। মিশনের ওয়েবসাইট www.alameenmission.org থেকে ফলাফল জানা যাবে। এছাড়া সফল পরীক্ষার্থীদের মোবাইল নম্বরে এসএমএস মারফতও ফলাফল জানানো হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct