এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: উড়ন্ত বিমানে অসুস্থ এক পরিযায়ী শ্রমিকের আপৎকালীন চিকিৎসা সেবা দিয়ে প্রাণে বাঁচানোয় বিমানযাত্রী ও কর্মীরা বিশেষভাবে সম্মান জানালেন আল আমীন মিশনের প্রাক্তনী তথা বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডিএম এন্ট্রান্সে দেশের মধ্যে প্রথম হওয়া তরুণ বাঙালি চিকিৎসক ডা. এমএম শাামিম ও তাঁর স্ত্রী ডা. নাজনিন পারভিন। তারা বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্স-এর বার্ষিক সমাবর্তন শেষে বিামনে করে কলকাতায় ফিরছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার। শনিবার একটি ইন্ডিগোর 6E503 ফ্লাইট বেঙ্গালুরুর কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ থেকে টেক অফ করে। যাত্রা শুরুর কিছু পরে, কেরালায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করা পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক একজন ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয়। তখন কেবিন ক্রু চিৎকার করে বলেন, প্লেনে কি কোন ডাক্তার আছেন, দয়া করে এসে আমাকে সাহায্য করুন? তখন এই তরুণ চিকিৎসক মেডিসিনে ডিএম (নিউরো) ডা. এমএম শামিম ও তাঁর স্ত্রী শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাজনিন পারভিন ওই রোগীর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তারা নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসা সেবার মধ্যে দিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছলে যাত্রীদের তরফে বিশেষ সম্মানান জানানো হয় ডা. শামিম ও তার স্ত্রী নাজনিনকে। সেই ছবি ও ওই্ দুই বাঙালি ডাক্তারের মানবসেবার কথা দেশের বিভিন্ন সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এখবর জানতে পেরে দৈনিক আপনজন-এর তরফে যোগাযোগ করা হয় ডা, শামিম ও ডা. নাজনিনের সঙ্গে। মুঠোফোনে ডা. শামিম ও ডা. নাজনিন ‘আপনজন’কে শোনার তাদের সেই অনন্য চিকিৎসা সেবার কথা। শুধু তাই নয়, উড়ন্ত বিমানের মধ্যে ঠিক কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সে কথাও অকপটে তারা বর্ণনা করেন। ডা. শামিম বলেন, আমরা গোল্ড মেডেল আনতে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্গালোর। গতকাল আমরা ফিরছিলাম ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা ১০.১৫ এর বিমানে। যখন আমরা বিমানে উঠলাম একসঙ্গেই বসেছিলাম। প্রায় আধাঘন্টা যাওয়ার পর হঠাৎ করে বিমানে একটা জরুরি ঘোষণা করল। এখানে একটা যাত্রী অসুস্থ তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। বিমানে যদি কোনও ডাক্তার বা নার্স থাকেন তাহলে দয়া করে আমাদের সাহায্য করবেন। বিমান তখন প্রায় অনেক উঁচুতে আধা ঘন্টার বেশি হয়েছে ছেড়েছে বিমানটি। আমরা দেখলাম কেউ উঠছে না। তখন আমার স্ত্রী নাজনিন পারভিন তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন ওই অসুস্থ যাত্রীর কাছে। গিয়ে দেখে রোগীটির তখন রক্ত বমি হচ্ছে এবং শ্বাস নিতে পারছেনা। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তখন সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রী আমাকে জানায় বিষয়টা। তখন আমিও যাই এবং দুজনে মিলে রোগীটির চিকিৎসা শুরু করি। আমরা বিমানের যারা ছিল তাদের বলি এমার্জেন্সি কি কি আছে তাদের কাছে। তার পর ওরা কিছু জিনিস আনলে আমার স্ত্রী তাড়াতাড়ি করে রোগীর হাতে চ্যানেল করে স্যালাইন চালু করে দেয়। আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে বলি। সাথে সাথে অক্সিজেনও চালু করে দিই। একজন সহযাত্রী আমাদেরকে অক্সিমিটার দিয়ে সাহায্য করেন। কিছু সময় পর আস্তে আস্তে রোগীর রক্ত বমিটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তবুও আমরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। তখন আরও একজন ডাক্তার এসে সাহায্য করেন। ডা. শামিম ও তার স্ত্রী নাজনিন আরও জানান, আমাদের বিমান তখন ভুবনেশ্বরের কাছাকাছি। পাইলট আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করতে হবে কি না। কিন্তু তাতে সবার সমস্যা এবং সেখানে ওই পরিবারের আদৌ চিকিৎসা করানোর মতো সক্ষম নয়। রোগীর পুত্র বলেছেন তারা গরিব, তাই তারা কলকাতায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি করাতে চান। আমার স্ত্রী এবং আমি দুজনেই বললাম আমরা এই রোগীকে কলকাতা পর্যন্ত নিয়ে যাব সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। আমরা বললাম খুব বেশিক্ষণ এই রোগীকে এই ভাবে রাখা সম্ভব নয়, যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। আমার পাইলটকে জিজ্ঞাসা করলাম কলকাতা যেতে এখনো কত সময় লাগবে পাইলট বলল এখনো দেড় ঘণ্টা। এই সময় এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্রায় ৮০ বছর বয়স হবে তার কিছু হার্ট এর ওষুধ আমার কাছে আছে ইমার্জেন্সিতে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু এই ওষুধ গুলো এই মুহূর্তে লাগবে না এই রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে। তবুও আমার সারাক্ষণ দেখাশোনা করে সুস্থ ভাবে রোগীকে নিয়ে কলকাতা পৌঁছতে সক্ষম হয়। তার পর আমরা রোগীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি রোগীর কিডনির সমস্যা আছে। লিভারের সমস্যা আছে। অনেক ইনফেকশন আছে। তার জন্য মুখ দিয়ে রক্ত উঠছিল। আমরা কলকাতা পৌঁছে নামার আগে আবার একবার দেখতে গেলাম এবং বিমান বন্দরের ডাক্তারের হাতে রোগীকে তুলে দেওয়া পর্যন্ত আমরা রোগীর কাছেই ছিলাম।
তারা আরও জানান, আমরা যখন বিমান বন্দরে নেমে যখন আমাদের ব্যাগ সংগ্রহ করছি তখন ওই ভদ্রলোক আবার আমাদের কাছে আসে এবং বলেন যে আপনারা এত সাহায্য করলেন রোগীকে এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করতে লাগলো কত মানুষের সময় বাঁচল কিন্তু পাইলট তো আপনাদের একটা ধন্যবাদও জানালেন না। সাধারণত বিমানে এরকম কিছু হলে পাইলট ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু এটা না করে পাইলট খুব খারাপ কাজ করলেন। তখন আমরা বললাম দেখুন আমরা তো এটা ভাবিনি এই কাজের জন্য পাইলট আমাদের ধন্যবাদ দেবেন। আমরা তো আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন ওই ভদ্রলোক সব যাত্রীদের দাঁড় করিয়ে আমাদেরকে একটা ধন্যবাদ জানালেন। শামিল হন বিমানবন্দরের কর্মীরাও। তখন উনি আমাদের একটা ছবি তোলেন। উল্লেখ্য, ডা. শামিম আল আমীন মিশনের প্রাক্তনী। তার বাড়ি হাওড়ায়। আর তার স্ত্রী নাজনিনের বাড়ি কোচবিহার। দুজনেই শিলিগুড়ির বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct