পাশারুল আলম, আপনজন: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ও মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, দুই মহাত্মাই উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এক—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করা। তবে তাঁদের রাজনৈতিক দর্শন, কর্মপন্থা, এবং কৌশল নিয়ে মতবিরোধ এতটাই প্রকট ছিল যে, এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক মতবিরোধ
মহাত্মা গান্ধী এবং সুভাষচন্দ্র বোসের মধ্যে প্রধান মতভেদ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত কৌশল নিয়ে। গান্ধীজির রাজনৈতিক দর্শন ছিল অহিংসা, সত্যাগ্রহ এবং ধৈর্যের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ব্রিটিশদের প্রতি মানবিক সহানুভূতি ও নৈতিক শক্তি দিয়ে তাঁদের মন পরিবর্তন করা সম্ভব। ব্রিটিশরা তখন ঔপনিবেশিক শাসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে বলে তাঁর ধারণা ছিল।
অন্যদিকে, সুভাষচন্দ্র বোসের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল র্যাডিক্যাল এবং কার্যত চরমপন্থী। তিনি মনে করতেন যে, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সরাসরি পদক্ষেপের মাধ্যমেই ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করা সম্ভব। বোস বিশ্বাস করতেন যে, একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী তৈরি করতে হবে এবং সেই বাহিনী দিয়ে ব্রিটিশ শাসনকে সামরিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) গঠন করেছিলেন এবং জার্মানি ও জাপানের মতো দেশগুলোর সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এই অবস্থান এবং কৌশল মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে মতবিরোধ
সুভাষচন্দ্র বোস ১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। যদিও কংগ্রেসের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর বিরাট প্রভাব ছিল, বোসের সভাপতিত্বকালে তাঁর এবং গান্ধীর সমর্থকদের মধ্যে মতবিরোধ প্রকট হয়। ১৯৩৯ সালে বোস আবারও কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন, কিন্তু গান্ধী ও তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে বোসের মতপার্থক্য এতটাই তীব্র হয় যে, শেষ পর্যন্ত তিনি সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপরে, তিনি তাঁর নিজস্ব দল “ফরওয়ার্ড ব্লক” গঠন করেন। বোসের নেতৃত্বে এই দলটি ভারতের স্বাধীনতার জন্য এক নতুন র্যাডিক্যাল পন্থা অনুসরণ করতে চেয়েছিল।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক
রাজনৈতিক মতবিরোধ সত্ত্বেও, মহাত্মা গান্ধী এবং সুভাষচন্দ্র বোসের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সম্মানসূচক। সুভাষচন্দ্র বোস মহাত্মা গান্ধীকে “জাতির পিতা” বলে সম্বোধন করতেন, এবং গান্ধীজির ব্যক্তিত্বের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। অপরদিকে, মহাত্মা গান্ধীও বোসের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। গান্ধীজী নেতাজীকে প্রকৃত দেশ প্রেমী মনে করতেন। যদিও তাঁদের রাজনৈতিক কৌশল ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত, তাঁরা দুজনেই জানতেন যে তাঁদের লক্ষ্য এক, এবং সেটা ছিল ভারতের স্বাধীনতা অর্জন।
হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস-এর সঙ্গে সম্পর্ক
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস এবং হিন্দু মহাসভা ও আরএসএসের সম্পর্ক ছিল বেশ জটিল। নেতাজি ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক নেতা, যিনি সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে শামিল করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। সাভারকার ও হেডগাভারের সঙ্গে নেতাজির কিছু রাজনৈতিক মতৈক্য থাকলেও তাঁদের আদর্শগত মতবিরোধ ছিল স্পষ্ট। নেতাজি ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহুত্ববাদী ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস হিন্দুদের জন্য আলাদা গুরুত্ব আরোপ করেছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌথ অবদান
মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র বোস উভয়েই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশাল অবদান রেখেছিলেন, যদিও তাঁদের পথ আলাদা ছিল। গান্ধীর অহিংস আন্দোলন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য সমর্থন তৈরি করেছিল। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের মানুষ এক হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, সুভাষচন্দ্র বোসের সশস্ত্র সংগ্রাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল, যা ব্রিটিশ শাসনের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
উপসংহার
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস এবং মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুটি বিপরীত মেরুর প্রতিনিধিত্বকারী, কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। তাঁদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও তাঁরা একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাঁরা দুজনেই অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন।
* মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct