পাশারুল আলম, আপনজন: শ্রীলঙ্কার ২০২৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। যা বিশ্ব রাজনীতি ও দেশটির ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলবে। এই নির্বাচনে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্টির মার্কসবাদী নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে ৪২.৩১%ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এই ফলাফল শ্রী লংকার ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জনগণের হতাশা এবং প্রত্যাখ্যানের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। মার্কসবাদী নেতা বিরোধী নেতা সজিথ প্রেমাদাসা এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহেকে পরাজিত করেছেন। দিসানায়েক দুর্নীতি-বিরোধী এবং শ্রমজীবী শ্রেণীর কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার করেছেন। তিনি নিজস্ব একটি প্ল্যাটফর্মকে সামনে রেখে জয়ী হলেন। গত নির্বাচনে 3% ভোট পেয়ে তিনি চরম ভাবে পরাজিত হন। আজকে সেই দিসানায়েক শ্রীলংকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। একজন সাধারন শ্রমিকের সন্তান হয়েও তিনি তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এই জয় কেড়ে নিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কায় দিসানায়েকের বিজয় শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক মানচিত্রকে নতুন করে চিত্রিত করেছে। তার প্রচারণার কেন্দ্রে ছিল দুর্নীতির অবসান এবং শোষিত ও বঞ্চিত জনগণের স্বার্থ রক্ষা। এই প্রেক্ষাপটে, শ্রীলঙ্কার ভোটাররা গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে একটি নতুন দিকনির্দেশনার আশা প্রকাশ করেছেন। দেশটি ২০২২ সালে এক চরম আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল, যার ফলে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোর ঘাটতি দেখা দেয়। এ সংকটের কারণে ব্যাপক বিক্ষোভের সম্মুখীন হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে এবং তাকে পদত্যাগ করতে হয়। শুধু তাই নয় তাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। অনেকটা বাংলাদেশের মতই ছিল সেদিনের আন্দোলন।
সালের ২০২২ সালের সেই বিশাল আন্দোলন এবং বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দেশটিকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে পারলেও জনসাধারণের মধ্যে তার নীতিগুলোর জনপ্রিয়তা কমে আসে। ভঙ্গুর অর্থনীতিকে বাঁচাতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) শর্তগুলি নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য আরও চাপ সৃষ্টি করে। ফলে তার প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। দিসানায়েক এই অসন্তোষের প্রতি মনযোগ দিয়েছেন। এই সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার এই জয়ের মধ্যে জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
দিসানায়েক শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যতকে পুনর্গঠনের জন্য একটি সাহসী পরিকল্পনা পেশ করেছেন। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি এই এম এফ (IMF) এর কঠোর শর্তগুলো পুনঃ আলোচনার উদ্যোগ নিবেন। যাতে সবচেয়ে দরিদ্র জনগণের ওপর বোঝা কিছুটা কমানো যায়। এছাড়া তিনি দেশের কৃষি, উৎপাদন এবং আইটি সেক্টরকে শক্তিশালী করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করবেন বলে জানিয়েছেন। তার এই অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। এই বিশ্বাসই জনগনের ভোটের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন শ্রীলঙ্কার আভ্যন্তরীণ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করার দিকে তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন।
যদিও দিসানায়েক নতুন অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তাই এই জয় শ্রীলঙ্কার জন্য এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি। তবে তার সামনে বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশটির ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং ক্রমবর্ধমান নিম্নগামী জীবনযাত্রায় জিডিপিকে এগিয়ে নিয়ে এসে ব্যয়ের সঙ্গে লড়াই করা এখনও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার তামিল বিরোধী মনোভাব প্রতিবেশী ভারতের সংগে কি রকম সম্পর্ক স্থাপন করবে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তবে জনগণের জন্য তিনি যে নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছেন, তা সামনের দিনগুলোতে শ্রীলঙ্কাকে একটি নতুন পথে নিয়ে যেতে পারে। দিসানায়েকের নেতৃত্বে দেশটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং তিনি যে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য নতুনভাবে এগিয়ে যাবেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে শ্রীলংকার জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষা কতটা পূর্ণ করতে পারবেন তা নির্ভর করছে আগামী দিনে তার প্রচেষ্টা কতটা সফল হয় তার উপর। এই নির্বাচন শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী রাজনীতিবিদদের পরাজিত করে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct