বিশ্বের যেকোনো দেশে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হয়। এই সমর্থন অর্জন ও শাসন অব্যাহত রাখার জন্য শাসকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে থাকে। ভারতবর্ষে, যেখানে ধর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গভীর, সেখানে সাম্প্রদায়িকতা একটি প্রাচীন ও কার্যকরী শাসন কৌশল হিসেবে দেখা হয়। শাসক যখন তার শাসনকে দীর্ঘকালীন ধরে রাখতে চায়, তখন শাসক পুঁজিবাদী সমাজ ও এক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষক তৈরি করে। এরা সবাই মিলিত হয়ে এক অক্ষ নির্মাণ করে। যারা সুকৌশলে সম্প্রদায়িকতা জিয়ে রেখে নিজের আসনকে মজবুত রাখতে চায়। লিখেছেন পাশারুল আলম...
বিশ্বের যেকোনো দেশে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হয়। এই সমর্থন অর্জন ও শাসন অব্যাহত রাখার জন্য শাসকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে থাকে। ভারতবর্ষে, যেখানে ধর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গভীর, সেখানে সাম্প্রদায়িকতা একটি প্রাচীন ও কার্যকরী শাসন কৌশল হিসেবে দেখা হয়। শাসক যখন তার শাসনকে দীর্ঘকালীন ধরে রাখতে চায়, তখন শাসক পুঁজিবাদী সমাজ ও এক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষক তৈরি করে। এরা সবাই মিলিত হয়ে এক অক্ষ নির্মাণ করে। যারা সুকৌশলে সম্প্রদায়িকতা জিয়ে রেখে নিজের আসনকে মজবুত রাখতে চায়।
ভারতের জনসংখ্যা ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত, যেখানে ৮৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু এবং বাকি ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী। তবে শাসন ও শোষণের প্রভাব কেবলমাত্র সংখ্যালঘুদের উপর সীমাবদ্ধ নয়, বরং ১০০ শতাংশ মানুষের উপরই এর প্রভাব থাকে। কিন্তু শাসক শ্রেণীর এক বিশেষ কৌশল হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার বীজ বপন করা, যাতে তারা নিজেদের শোষণের দিকে মনোযোগ দিতে না পারে এবং শাসকের শাসন অব্যাহত থাকে।
ধর্মীয় উন্মাদনা: শাসনের হাতিয়ার
ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে শাসকরা জনসাধারণের মনোযোগ তাদের জীবনযাত্রার অবনতির দিক থেকে সরিয়ে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, পেট্রোল, ডিজেল, এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এমন একটি বিষয় যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে প্রভাবিত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেহেতু গাড়ি ও অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিবহনের ব্যবহার বেশি করে, তারা সরাসরি এই মূল্যবৃদ্ধির শিকার হয়। যদি শাসকরা ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে সমাজের একটি বড় অংশকে ব্যস্ত রাখতে পারে, তাহলে এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবাদ করার সম্ভাবনা কমে যায়। এছাড়া বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় চিকিৎসা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রতিটি মানুষকে প্রতিনিয়ত কোন না কোন ওষুধ ক্রয় করতে হয়, চিকিৎসা নিতে হয়। এই ওষুধের দাম ও চিকিৎসা প্রণালীর মূল্য আকাশ ছোঁয়া। চিকিৎসা ও ওষুধের মূল্য বৃদ্ধিকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য আরেক ওষুধের প্রয়োজন। সেই ওষুধ হলো সাম্প্রদায়িকতা।
আসলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করার মাধ্যমে শাসকরা মানুষের মনোযোগ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার দিক থেকে সরিয়ে রাখে। যখন মানুষ ধর্মীয় উত্তেজনায় মগ্ন থাকে, তখন তারা পেট্রোলের দাম, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বা কর্মসংস্থানের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যায়। এর ফলে শাসকের শাসন ও পুঁজিবাদীদের শোষণ অব্যাহত থাকে এবং জনগণ প্রকৃত সমস্যার দিকে মনোযোগ না দিয়ে অন্য দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে চেতনার দৃষ্টি হারায়। এই চেতনাহীন বিবেকের তাডনা এক সময় ঘৃণায় পর্যবচিত হয়। মনের ভিতর পালিত ঘৃণায় এক সময়ে হিংসার রূপ নেয়। এই হিংসাই একসময় আক্রোশের সৃষ্টি করে। এই আক্রোশের ফল কখনো কখনো চরম রূপ ধারণ করে।
কর ও শোষণের প্রকৃতি
জিএসটি বা অন্যান্য করের মাধ্যমে শাসকরা সাধারণ জনগণের উপর আরও বেশি শোষণ চালায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন পণ্য—সব ক্ষেত্রেই কর আরোপ করে জনগণের কাছ থেকে মোটা রকমের অর্থ আদায় করা হচ্ছে। যেহেতু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা কম, তারা তুলনামূলকভাবে কম কর প্রদান করে। অন্যদিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ, যাদের ক্রয়ক্ষমতা অধিক, তারা করের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। সাধারণ মানুষদের যাতে কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে না পারে, তার জন্য শাসক ধর্মীয় উত্তেজনার আশ্রয় নেয়। এমন সমস্ত তথ্য ও ভাষণ উপস্থাপন করে যাতে করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে দেশ ও দেশবাসীর মূল শত্রু হচ্ছে সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ। তাদের কথায় দেশের মূল ক্রিম খেয়ে যায় সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ। এমনকি আজগুবি হিসেব পর্যন্ত দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। যেমন সংখ্যালঘুরা একদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম সংকটের মধ্যে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম বিপদের মধ্যে আছে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে গেলে সংখ্যালঘু সমাজের প্রতি সর্বদা অন্য এক রকমের দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বয়কট করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিত্য নতুন ইস্যু তৈরি করে মানুষের মনকে তার দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া পাওয়াকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রিয়া করে।
বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান
ভারতে বেকারত্ব একটি বিশাল সমস্যা। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিবর্তে শাসকরা ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বেকার যুবসমাজ যাতে শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে, তার জন্য তাদের ধর্মীয় উত্তেজনায় বিভ্রান্ত করা হয়। দেশের ৯৫/৯৬ শতাংশ চাকরিজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মানুষ করে থাকে। অন্যদিকে সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ দৈনিক মজুরি, রিকশা, ভ্যানচালক, রাজমিস্ত্রি, মোটরগাড়ি মিস্ত্রি, দর্জির কাজ করে। সরকার নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না করায় বেকারত্বের হার বাড়ছে। এই বেকারত্বের যন্ত্রণায় যুবসমাজ যাতে এই সমস্যার সমাধান না চায়, তার জন্য তাদের ধর্মীয় উন্মাদনায় মগ্ন করে রাখে।
এই ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে মুক্তির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে ধর্মীয় উন্মাদনা প্রতিহত করা সম্ভব। ধর্মীয় উন্মাদনা প্রায়শই অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য, মানবতা ও সহনশীলতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে। যুক্তিবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সমাজের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও এই ধর্মীয় উন্মাদনা প্রকট হতে শুরু করেছে। তার কারণ হলো শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা সম্বন্ধে সীমিত জ্ঞান প্রদান করা হয়ে থাকে।ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অর্থ ব্যাখ্যা না করে ভুল অর্থ নিয়ে প্রচার করা হয়ে থাকে। আসলে রাষ্ট্র থাকবে ধর্ম নিরপেক্ষ। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রচার করা। তৎসঙ্গে রাষ্ট্র এবং সমাজের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রয়োগ করা। তাহলে ধর্মীয় উন্মাদনার প্রভাব কমতে পারে। রাষ্ট্রের উচিত ধর্মকে ব্যক্তি বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং রাষ্ট্র বা সামাজিক নীতিতে ধর্মের হস্তক্ষেপ কমানোর জন্য সচেতনভাবে নীতি নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরী।
সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার জন্য কবিগুরুর কথায় “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।” এর জন্য চাই পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নিজেদের মধ্যে সংলাপ, আলোচনা। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সাথে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এবং সম্পর্ক স্থাপন করা। তাদের জীবন যাত্রা সহ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে অল্প বিস্তর জ্ঞান অর্জন করা। এটা করলে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। ধর্মীয় উন্মাদনা কমাতে পারস্পরিক সম্মান ও যোগাযোগের বিকল্প নেই। এই পারস্পারিক সম্মান ও যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য ছোট ছোট গ্রুপ করে অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে গিয়ে আলাপ আলোচনা করা। পাশাপাশি এ বিষয়ে সতর্ক থাকা যে কমবেশি সমস্ত ধর্মে মৌলবাদ দেখা যায়। এই ধর্মীয় মৌলবাদী চিন্তা থেকে আসে পারস্পরিক ঘৃণা। তাই সমস্ত ধর্মের মৌলবাদকে চিহ্নিত করে তার বিরোধিতা করা এবং সমাজে উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া সংস্কৃতির বিনিময় ও প্রয়োগের ভূমিকা যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানের মাধ্যমে মানুষকে ঐক্য ও সহনশীলতার বার্তা দেওয়া যায়। খেলাধুলা ও সংস্কৃতি মানুষকে যুক্ত করতে পারে, যা ধর্মীয় উন্মাদনার বিপরীতে কাজ করে।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যা থেকেও ধর্মীয় উন্মাদনা কাজ করে। অনেক সময় মানসিক চাপ, হতাশা, কিংবা ভ্রান্ত ধারণা থেকে সম্প্রদায়িক মন সৃষ্টি করতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে এবং মানসিক সহায়তা প্রদান করে মানুষকে এসব সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। সব চেয়ে বড় কথা হল
ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে মুক্তি পেতে মানুষের মাঝে যুক্তিবাদ, মানবিকতা এবং সহনশীলতার বোধ জাগ্রত করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, শাসনব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে শাসকরা জনগণের মনোযোগ প্রকৃত সমস্যা থেকে সরিয়ে রাখছে, এবং শোষণ অব্যাহত রাখছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই আসলে এই শোষণের মূল শিকার, কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, কারণ তাদের ধর্মীয় উন্মাদনায় ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। এই শোষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে, জনগণকে ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং শাসকের প্রকৃত কৌশল বুঝতে হবে।
**মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct