এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র মেধাবী ছোট ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। প্রথম জীবনে পান-বিড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমার অন্তর্গত পূর্বস্থলী-১ ব্লকের বগপুর পঞ্চায়েতের শাহজাদপুর গ্রামের বাসিন্দা শেখ হাজিফুল ইসলাম। তার তিন সন্তানকে বড় করতে কম বেগ পেতে হয়নি। শেষমেষ চাষের জমিও বিক্রি করতে হয়। পরবর্তীতে মুদি দোকান করেন হাজিফুল ইসলাম। ছোট ছেলে শেখ মোবারক হোসেন অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় অর্ধেক খরচে আল-আমীন মিশনে পড়াশোনার সুযোগ পান। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় চলতি বছরেই ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান ছেলে মোবারক। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছেও কার্যত পূরণ হওয়ার পথে এগিয়ে চলে। এমবিবিএস পাস করার পর ইন্টার্নশিপে পাওয়া স্টাইপেন্ডের টাকার একাংশ বাড়িতে পাঠানো শুরু করে মোবারক। হাসি ফুটতে থাকে পরিবারের সদস্যদের মুখে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে হাউস স্টাফ ডাক্তার হিসাবে নিয়োগের কাউন্সিলিং হয় ডা. মোবারক হোসেনের। ওই মাসেই ১৬ই আগস্ট তার জয়েনিং ছিল বর্ধমান মেডিকেল কলেজেই। কিন্তু ১১ই আগস্ট রাতে সবকিছুই যেন তছনছ হয়ে গেল। ছেলের মৃত্যু হল। কি কারনে মৃত্যু হল? কারা মারল? সবটাই আজও অজানা। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে টেলিফোন আপনজন প্রতিনিধিকে এ ঘটনা বলতে বলতে কার্যত স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েন ডা. শেখ মোবারক হোসেনের পিতা শেখ হাজিফুল ইসলাম। নিহত ডাক্তারি পড়ুয়ার পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১১ আগস্টের রাতে সিনিয়ররা তাকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানান। সেদিন ভোরেই কলেজ হস্টেলের নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায় ওই ছাত্র শেখ মোবারক হোসেনকে (২৩)। ভোরে রক্তাক্ত অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, তখন পরণে অন্তর্বাসটুকু ছিল। মোবারকের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার। তারা ঘটনার বিচার চেয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডা. মোবারক হোসেনের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ পরিবারের। পিতা শেখ হাজিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে সরাসরি খবরও দেয়নি। হাসপাতালের এক পড়ুয়া মারফত খবর পাই— মোবারক হাসপাতালে ভর্তি। গিয়ে দেখি মারা গিয়েছে। আমি জানতে চাই কী করে এটা হল? ওরা বলেছিল রাতে পার্টি করেছে। অতিরিক্ত মদ খেয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করি। বলি ওকে খুন করা হয়েছে। আঘাতের চিহ্ন ছিল শরীরে।’ নিহত ডাক্তারের বাবা ‘আপনজন’কে আরও জানান, যে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মদ্যপানের প্রমাণ মেলেনি। তিন তলা থেকে মোবারকের পড়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও, শরীরের সব হাড় অটুট ছিল। তিনি বলেন, ‘‘আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত যে ছেলেকে খুন করা হয়েছে।’’ ঘটনার পর থেকে তিন বছর কেটে গেলেও ছেলের মৃত্যুর বিচার পাননি বাবা শেখ হাজিফুল ইসলাম। মৃত জুনিয়র ডাক্তারের পিতা বলেন, ‘আমরা ছেলের মৃত্যুর বিচার চেয়ে মামলা করি । সেই মামলায় তারিখের পর তারিখ পড়ে, আজও ঠিকঠাক শুনানি হয় না। কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ সিআইডি’র ওপর তদন্তভার দেয়। আমরা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে সিবিআই তদন্ত চেয়ে আবেদন জানাই। গত এপ্রিল মাসে শেষ শুনানি হয়।’ বিচার তো দূরের কথা তদন্ত প্রক্রিয়ার গতিপথ নিয়েও বর্তমানে স্পষ্ট ধারণা নেই পুত্রহারা অসহায় পরিবারের। ‘বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ছেলের কিভাবে মৃত্যু হল কারা মারল সেটাই এখনও স্পষ্টভাবে জানতে পারলাম না’ আক্ষেপ প্রকাশ করে নিহত জুনিয়র ডাক্তারের পিতা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে আরজি কর কাণ্ডের আবহে ডা. মোবারক হোসেনের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে চিকিৎসক সংগঠন মোবারকের পরিবারকে আইনি সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস’র অন্যতম নেতা ডা. সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, মোবারকের পরিবার যদি মনে করে বিচারের দাবিতে পুনরায় আইনি লড়াই লড়বেন, তাহলে আমরা সাথে আছি। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাবেন কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডাক্তার সংগঠনের পক্ষ থেকে সুবর্ণ গোস্বামী ‘আপনজন’কে বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কোথায়, মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে দুবার বৈঠক করেছেন। কিন্তু তিনি নিজের কথাই বলেছেন। তবে ওই পরিবার বিচার পাওয়ার জন্য আইন পথে বা কোন প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে চাইলে আমাদের সিনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ওই পরিবারের পাশে থাকবে, সহায়তা করবে। যেসময়ে জুনিয়র ডাক্তারের মৃত্যু হয় সেই সময় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন সুহৃতা পাল। তিনি চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন একাধিক অভিযোগ ওনার বিরুদ্ধে আছে। উনি সিন্ডিকেটের মাথা ছিলেন। পাশাপাশি সে সময়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের বেতাজ বাদশা ছিলেন অভিক দে। ফলে যে কোন কিছুই ঘটে যাওয়া সম্ভব। অতএব মোবারকের পরিবার যে প্রশ্নগুলো তুলছে সেগুলো আমাদেরও প্রশ্ন। তাই পরিবার যদি মনে করে নতুনভাবে আইনি লড়াই শুরু করবে আমরা তাদের পাশে আছি। সর্বতোভাবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব।’ তবে নিহত জুনিয়র ডা. মোবারক হোসেনের পিতা শেখ হাজিফুল ইসলাম বলেন, ‘আইনি লড়াই লড়বার জন্য আমার আর্থিক সামর্থ্য নেই। ছেলের মৃত্যুর পরও কোনরকম সরকারি আর্থিক সহযোগিতাটুকুও পাইনি। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর একবার করে স্ট্রোক হয়ে গেছে। নিয়মিত ঔষধ খেতে হয়। বড় ছেলের সামান্য রোজগার। সংসার চালানো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তবে আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তার সংগঠনসহ সকলে যদি পাশে দাঁড়ায় তাহলে আমার পুত্রের ন্যায়বিচার পেতে পারি।’ একই সঙ্গে তিনি আরজি করের তিলোত্তমার ন্যায়বিচারও চান।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct