সজল মজুমদার, আপনজন: “বিদ্যা হলো সব থেকে বড় সম্পদ, বিদ্যা শুধু আমাদের নিজেদের উপকার করে না, বরং প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে গোটা সমাজের কল্যাণ সাধন করে”- বিদ্যাসাগরের নানান শিক্ষামূলক বাণী গুলোর প্রকৃত অর্থ আজকের সময়ের সমাজব্যবস্থায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়তো হয়ে উঠেছে। তৎকালীন সময়ে বিদ্যাসাগর সমাজ ব্যবস্থার মূলে সজোরে কুঠারাঘাত করেছিলেন। ঘুন ধরা সমাজকে তিনিই মূল স্রোতে নিয়ে আসবার জন্য নানা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। নানান কু প্রথা, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা সমূলে অবলুপ্ত করবার জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তবে আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও কু প্রথা, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথার ছিটা ফোটা নিদর্শন কোথাও কোথাও আমাদের চোখে পড়লেও পড়তে পারে, নজরে আসতে পারে। অন্যদিকে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ওপর তিনি যে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন সেটিও আজকে অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক। আজকের দিনে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়ারা নিজের মাতৃভাষায় কথোপকথনের পরেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই মাতৃভাষাকেই শিক্ষাঙ্গনে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পরিগণিত করছে। ফলস্বরূপ মাতৃভাষায় কথোপকথনের ক্ষেত্রেও পরবর্তীতে তাদের মধ্যে জড়তাভাব ফুটে উঠছে। যদিও বিদ্যাসাগর প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সমন্বয়েই তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখনকার সময়ে প্রথাগত ভারতীয় শিক্ষার বদলে পাশ্চাত্য শিক্ষা ক্রমশ যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পাশাপাশি বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাকে প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। সংস্কৃত একটি অতি মূল্যবান এবং প্রাচীন ভাষা। সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা কে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ব্যাকরণ গ্রন্থ , তৎসহ আরো নারান বই রচনা করেছিলেন। কিন্তু আজকের দিনে সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব ক্রমশ যেন কমছে। স্কুল শিক্ষায় পাঠক্রমে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী পর্যন্ত সংস্কৃত আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। উচ্চশিক্ষায় সংস্কৃত নিয়ে পড়বার ঝোঁক পড়ুয়াদের মধ্যে হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে আবার বিদ্যাসাগর প্রণীত “ বর্ণপরিচয়” এর মাধ্যমে আজও শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শুরুতে ‘ বর্ণমালা’ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সমাজসেবী বিদ্যাসাগর দীন, দুঃখী, অসহায় মানুষকে সেবা করবার ব্রত নিয়েছিলেন। তেমনই আজকের দিনেও তার সেই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক পরোপকারী মানুষ নরনারায়ণ সেবার পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছেন। সর্বোপরি নারী জাতিকে শক্তিশালী করবার জন্য তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আজও স্মরণীয়। মানবতাবাদী দীক্ষিত বিদ্যাসাগর নারীজাতিকে শক্তিশালী করবার জন্য নারী শিক্ষায় জোর দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুলের ধারণা আজও বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচলিত। নারী জাতির প্রতি নির্যাতন রোধ করতে ও নারী ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে তিনি বিধবা বিবাহ, বাল্যবিবাহ বন্ধে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সমাজ ও সংস্কৃতিকে সঠিক দিশা দেখানোর লক্ষ্যে নারীজাতিকে তিনি সঠিক পথে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আজকের এই সংবেদনশীল সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগরের নারীজাতির প্রতি ধ্যানধারণার অনুসরণ বা অনুকরণকারী শত শত হৃদয়বান মানুষের অতীব প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন সেটা সহজেই অনুমান করতে পারা যাচ্ছে নিশ্চয়ই! সময়ের কালচক্রে আজকে বিদ্যাসাগর, রামমোহনের নীতি আদর্শের সঠিক প্রয়োগকারী মানুষগুলোর কোথাও যেন দরকার হয়ে পড়ছে। মানুষের অভাব নেই, হ্যাঁ, কিন্তু বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বিবেকানন্দের নীতি-আদর্শকে আজকের যুগে বহনকারী প্রকৃত মানুষের বড়ই যেন অভাব। তাই বিদ্যাসাগরের মূল্যবোধ, নীতিবোধ, শিক্ষা দর্শকে নিয়ে আজকের সমাজ তথা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো সচল ও সুগঠিত করবার উদ্দেশ্যে তার ২০৪ তম জন্মবার্ষিকী শুধুমাত্র উদযাপিত না করে আরো একবার পরীক্ষিত করবার জন্য সময় যেন ডাক দিচ্ছে। আর সময়ের ডাকে সাড়া দেওয়াই প্রকৃত মানবধর্ম।
লেখক: শিক্ষক এবং প্রাবন্ধিক, বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct