পাশারুল আলম, আপনজন: ভারতীয় রাজনীতি বহু বছর ধরে নানান পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আসছে, যেখানে বিভিন্ন নেতা ও রাজনৈতিক দল জনগণকে প্রভাবিত করার জন্য নানা রকম কৌশল গ্রহণ করেছে। মিথ্যা ভাষণ বা ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার প্রবণতা এই কৌশলগুলির মধ্যে অন্যতম, যা শুধুমাত্র ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের রাজনীতিতেই এক বড় সমস্যা।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সত্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যখন রাজনৈতিক নেতারা মিথ্যা বা ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, তখন তা গণতন্ত্রের মূল চেতনাকে দুর্বল করে তোলে। এটি শুধু ভোটের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে।
মিথ্যা ভাষণের প্রভাব:
মিথ্যা ভাষণ ব্যবহার করে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা ভারতীয় রাজনীতির এক অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতারা যখন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন বা ভ্রান্ত তথ্য ছড়ান, তখন তারা ভোটারদের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এর ফলে সঠিক নেতা বা দল নির্বাচিত হওয়ার পরিবর্তে, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ভোটাররা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, একাধিক নির্বাচনেই এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে নেতারা নির্বাচনের আগে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যেমন বেকারত্ব দূরীকরণ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন। কিন্তু নির্বাচনের পর দেখা যায়, এই প্রতিশ্রুতিগুলির অনেকটাই পূরণ হয় না, এবং সেগুলি শুধুমাত্র ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য দেওয়া হয়েছিল।
স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, প্রতি বছর দুই কোটি রোজগার, সফল স্বচ্ছ ভারত অভিযান, বিদেশ থেকে সমস্ত কালো টাকা ফিরিয়ে নিয়ে এসে জনগণের মধ্যে বিলি বন্টন করে দেওয়া হবে, মুসলিমদের বার্থ রেট নিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশন, নোট বন্দি করে সন্ত্রাসবাদ, কালো টাকা উদ্ধার করা সম্ভব, “কেউও ভারতের সীমান্ত পার করেনি, কোনো ভারতীয় সীমানা লঙ্ঘন করা হয়নি।” এই বলে ভারত ভূখণ্ডে চীনের অনুপ্রবেশ অস্বীকার করা। এইরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সাধারণ মানুষ এই সমস্ত বক্তব্য শুনে বিভ্রান্ত হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে। এই ভুলের মাসুল দিতে হয় দেশ ও দেশবাসীকে।
বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িকতা:
ভারত একটি বহুজাতিক ও বহু ধর্মীয় দেশ। এখানে ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত বিষয়গুলি খুবই স্পর্শকাতর। নেতারা মিথ্যা ভাষণ ও তথ্যের মাধ্যমে এই বিষয়গুলি নিয়ে খেলা করেন, যাতে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, নেতারা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা ধর্মীয় বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়ে ভোটারদের মনকে বিভক্ত করে নিজেদের পক্ষে ভোট টানতে চান। এই প্রবণতা কোথাও দলগতভাবে কোথাও আদর্শগতভাবে সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার ও প্রসার করা হয়। এমন সব তথ্য উপস্থাপন করা হয় যা সত্যের ধারে কাছেও নেই। সাধারণ মানুষ ছাপা অক্ষরের সোশ্যাল মিডিয়া এই অসত্যকে সত্য মনে করে। এটি শুধু সমাজকে বিভাজিত করে তোলে না, বরং সংঘাত ও হিংসার পরিবেশ তৈরি করে।
সচেতনতার অভাব:
মিথ্যা ভাষণ ও তথ্য ছড়ানোর আরেকটি বড় কারণ হলো সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। অনেক ভোটার সঠিক তথ্য না জেনে বা যাচাই না করে নেতাদের ভাষণকে বিশ্বাস করে ফেলেন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফেক নিউজ ও মিথ্যা প্রচারণা যখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভোটারদের বিভ্রান্ত করা আরও সহজ হয়ে যায়। এই বিপদ শুধু ভোটের বাক্সে প্রভাব বিস্তার করে তাই নয়, সমাজের অন্তরস্থলে মানুষের মন বিষাক্ত হয়ে যায়। এই বিষ ছড়িয়ে পড়ে নানা স্তরে। এই বিষ শৈশব কালে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঘরে ঘরে এই বিষ পৌঁছে দেওয়ার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার ফলে সমাজে অশান্তি হিংসা যেমন দেখা দিচ্ছে তেমনি ভারতের যে ঐতিহ্য সম্প্রীতি রক্ষা করা, সেই সম্প্রীতি ক্ষেত্রেও সংকট এসে গেছে। এই সংকট থেকে বের হওয়ার একমাত্র রাস্তা সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মিথ্যা তথ্য ও ফেক নিউজকে চিহ্নিত করে যথাযথ সঠিক তথ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।
প্রতিরোধ এবং সমাধান:
মিথ্যা ভাষণ ও ভ্রান্ত তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের দায়িত্ব হলো সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে মিডিয়া, সামাজিক সংস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। ভোটারদেরকে সত্য যাচাই করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে, এবং সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের মতামত গঠনের সুযোগ দিতে হবে।
ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে ফেক নিউজ ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে আংশিক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র সরকারি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়, ফেক নিউজ চেক করার জন্য সরকারিভাবে ব্যবস্থা প্রায় নেওয়া হয় না। শুধুমাত্র সরকার বিরোধী কোন ফেক নিউজ হলে সরকার জেগে উঠে। এর ফলে ফেক নিউজ যারা ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অল্ট নিউজ এর মত একাধিক সংগঠন এই কাজের প্রতি উৎসর্গীকৃত হলে ফেক নিউজ ও মিথ্যা ভাষণ প্রণয়নকারীদের আটকানো সম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা তৈরি করা এবং মিথ্যা ভাষণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজন।
উপসংহার:
মিথ্যা ভাষণের মাধ্যমে ভোট পাওয়া শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি একটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করার মারাত্মক প্রক্রিয়া। ভারতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব মারাত্মক, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই, আমাদের দায়িত্ব হলো সত্য এবং সঠিক তথ্যের প্রচার ও প্রসার ঘটানো, এবং মিথ্যা ভাষণ ও ভ্রান্ত তথ্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct