এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে টাইপ ২ ডায়াবেটিস (T2DM) দীর্ঘমেয়াদে পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ, যা নিউরোপ্যাথি এবং হৃদরোগের মতো জটিলতার সৃষ্টি করে। এই রোগের চিকিৎসা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে হয়ে থাকে, যা অনেকের জন্য ব্যয়বহুল, অন্যদিকে সফলতার হারও সীমিত। এই সমস্যার সমাধানে এক যুগান্তকারী ‘ভ্যাকসিন’ উদ্ভাবন করেছেন বাঙালি গবেষক অধ্যাপক গওসাল আজম খান। বর্তমানে তিনি সৌদি আরবের কিং ফয়সল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। এই ভ্যাকসিনটি ইতোমধ্যেই আমেরিকার পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক অফিস থেকে অনুমোদন পেয়েছে। গত ৯ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী পেটেন্ট কনফার্মেশন নম্বর ২৮০৯ ৷
এ বিষয়ে গবেষক ড. গওসাল আজম খান বলেন, 'গবেষণায় দেখা গেছে, ভন উইলব্র্যান্ড ফ্যাক্টর (vWF) নামক একটি বহুগুণী গ্লাইকোপ্রোটিন মেগাকারিওসাইট ও এন্ডোথেলিয়াল কোষ থেকে উৎপন্ন হয় এবং স্ট্রেসের সময় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (IR) সৃষ্টি করে। এটি নাইট্রিক অক্সাইড (NO) সংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত করে।' ভন উইলব্র্যান্ড ফ্যাক্টর vWF-এর নির্দিষ্ট একটি অংশ ইনসুলিন রিসেপ্টরের সাথে প্রতিযোগিতা করে ইনসুলিনের কার্যকারিতা ব্যাহত করে এবং এর মাধ্যমে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। এই নির্দিষ্ট অংশটি যখন একটি অ্যান্টি-নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি দ্বারা নিষ্ক্রিয় করা হয়, তখন নাইট্রিক অক্সাইড (NO) উৎপাদন পুনরুদ্ধার হয় এবং শরীরের কোষে গ্লুকোজ গ্রহণের হার বৃদ্ধি পায়।' অধ্যাপক গওসাল এই ভন উইলব্র্যান্ড ফ্যাক্টর vWF-এর একটি প্রোটিন সিকোয়েন্স চিহ্নিত করেছেন, যা স্ট্রেস-প্ররোচিত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে সক্ষম এবং এটিকে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কোনো কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়নি। অধ্যাপক গওসালের এই উদ্ভাবন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। ভ্যাকসিনটি সফল হলে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ গ্রহণের ঝামেলা কমবে এবং সাশ্রয়ী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এটি দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
জানা গিয়েছে, অধ্যাপক গবেষক গওসাল আজম খান দেশ-বিদেশের নামীদামি সংস্থায় গবেষণা এবং অধ্যাপনা করেছেন ৷ লন্ডনের প্রখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা 'রয়্যাল সোসাইটি অফ বায়োলজি'র 'চার্টার্ড সায়েন্টিস্ট' সম্মানে ভূষিত হন বাঙালি গবেষক ও অধ্যাপক গওসাল আজম খান। দেশ-বিদেশের প্রায় দুই ডজন সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কাজ করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও'তেও। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, জাপান, কানাডা প্রভৃতি দেশের নামীদামি সংস্থায় গবেষণামূলক কাজ করেছেন গওসাল আজম খান। প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের ৯ আগস্ট পশ্চিম মেদিনীপুরের মোহনপুর থানার অন্তর্গত আঁতলা গ্রামে অধ্যাপক গওসাল আজম খানের জন্ম। তাঁর মরহুম পিতা হাজি আবদুল আজিজ খান ছিলেন সাধারণ চাষি, মা সাবাতুন বিবি গৃহবধূ। স্ত্রী কামরুজ জাহান আলিগড়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। দুই কন্যার একজন আমেরিকার হফকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যজন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়েযে পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে পড়াশুনা করছেন।
অধ্যাপক গওসাল আজম খান ১৯৮৯ সালে গড়হরিপুর জি.এন. হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। তার আগে তিনি কাসবাগোলা হাই মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন মেদিনীপুরেরই পাঁচরোল হাইস্কুল থেকে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ১৯৯৫ সালে ফিজিওলজি নিয়ে সাম্মানিক স্নাতক হন। ১৯৯৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেল পান। তিনি ফিজিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার তরফ থেকে প্রফেসর এ.কে. মুখার্জি মেমোরিয়াল মেডেল অ্যাওয়ার্ড পান। ২০০৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। কিছুদিন সুইডেনে কাজ করেন, তারপর চলে যান আমেরিকা। বিজ্ঞান গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে আমেরিকা থেকেই বেশ কতকগুলি অ্যাওয়ার্ড পান। জাপান ও কানাডাতেও ছিলেন কিছুদিন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা 'ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন' বা ডিআরডিও'তে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসাবে যোগ দেন। কাজ করেন প্রায় ৮ বছর। ফের পাড়ি জমান বিদেশে ৷ ফিজির স্কুল অফ মেডিসিন-এ অধ্যাপনা করেন। বর্তমানে সৌদি আরবের কিং ফয়সাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন গওসাল আজম খান ৷
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct