ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় ও জনবহুল দেশে জাতি এবং জনগণনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক পদক্ষেপ। যা নিয়ে দেশ ব্যাপী একটি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এই গণনা প্রক্রিয়া শুধুমাত্র জনসংখ্যার প্রকৃত অবস্থা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর নির্ভুল বিশ্লেষণ করতে সহায়ক হয়। তাই দেশের বিশেষ একটি গ্রুপ সার্ভে করে, তাতে ৭৪% মানুষ জাতি গণনার পক্ষে মত দেন। লিখেছেন পাশারুল আলম...
ভা রতের মতো বৈচিত্র্যময় ও জনবহুল দেশে জাতি এবং জনগণনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক পদক্ষেপ। যা নিয়ে দেশ ব্যাপী একটি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এই গণনা প্রক্রিয়া শুধুমাত্র জনসংখ্যার প্রকৃত অবস্থা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর নির্ভুল বিশ্লেষণ করতে সহায়ক হয়। তাই দেশের বিশেষ একটি গ্রুপ সার্ভে করে, তাতে ৭৪% মানুষ জাতি গণনার পক্ষে মত দেন। জাতি ভিত্তিক জনগণনার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গসহ প্রতিটি রাজ্যে, কেন্দ্রীয় স্তরে জাতিগত বৈষম্য নির্ধারণ করে পিছিয়ে পড়া শ্রেণী যেমন: তফসিলি জাতি (এসসি), তফসিলি উপজাতি (এসটি) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর (ওবিসি) মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নতির পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব। এই প্রেক্ষাপটে জনগণনার সঙ্গে জাতি গণনা একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়। ১৯১১ সালের পর এই জাতি গণনা হয়নি। সেই পুরোনো হিসেব ধরে আজও চলছে দেশ। এর মধ্যে দেশ ভাগ হয়েছে। দেশভাগের ফলে উভয় দেশের নাগরিক এদেশ থেকে ওদেশে গেছে ওদেশ থেকে এ দেশে এসেছে। পাশাপাশি জন্মবৃদ্ধি বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ হেরফের হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই একশ বছরের পুরনো হিসাব ধরে আর যাই হোক জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা জানি প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার নিয়ম থাকলেও করোণা মহামারীতে ২০২১ সালে জনগণনা হয়নি। যা এবার শুরু হতে চলেছে।
তবে জাতি ভিত্তিক জন গণনা (caste-based census) নিয়ে বিতর্ক ভারতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিতর্কের মূল কারণ হলো জাতি ভিত্তিক গণনার প্রভাব ও ব্যবহার নিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বন। এই মতাবলম্বন সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের উপরে ভিত্তি করে। উভয় পক্ষের যুক্তি নিজের নিজের যুক্তি উপস্থাপন করে চলেছেন।
যে সমস্ত মানুষ ও রাজনৈতিক দল জাতি ভিত্তিক জনগণনা চাইছেন তাদের যুক্তি হল:
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন: জাতি ভিত্তিক গণনা সরকারের জন্য সুবিধা জনক উপায়। বঞ্চিত, অনগ্রসর এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য এটি জরুরি। এর মাধ্যমে বৈষম্য দূর করতে কার্যকর নীতি গ্রহণ করা সম্ভব।
সংরক্ষণের পুনর্বিবেচনা: অনেক দল মনে করে, বর্তমান সংরক্ষণ নীতিতে বৈষম্য রয়েছে এবং এই গণনা দ্বারা প্রকৃত সংখ্যা বোঝা গেলে সংরক্ষণ ব্যবস্থায় আরও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।ইংরেজ আমল থেকে আজকের আমাদের দেশ বহু ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে তাই পুরনো হিসেব ধরে উন্নয়নের বা সংরক্ষণের পরিমাপ করা সঠিক নয় বলে অনেকেই মনে করেন।
সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন: সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রকৃত চিত্র উপলব্ধি করে, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনার করার জন্য জাতি গণনার মাধ্যমেই সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। তাই এটি অতি গুরুত্বপুর্ন বিষয়। এই জাতি গণনাকে এড়িয়ে জন গণনা অসম্পূর্ণ একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করবে।
রাজনৈতিক শক্তি: জাতিগত জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা জানা গেলে নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও শক্তি পুনঃস্থাপন করতে পারবে। নিজস্ব জনজাতির হিসেব না থাকায় যে সমস্ত জনজাতি সমাজে অনাদিকাল ধরে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে তা চিরকাল থেকেই যাবে। তাই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ও সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাধিকার অর্জনে জাতির গণনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
জাতি ভিত্তিক জন গণনার বিপক্ষে যারা বলেন, তারা মনে করেন-
জাতি ভিত্তিক বিভাজন সৃষ্টি হবে: সমালোচকরা মনে করেন, জাতি ভিত্তিক জন গণনা সমাজে আরও জাতিভিত্তিক বিভাজন এবং উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা ঐক্যের বিপরীতে কাজ করবে।
জাতিগত রাজনীতির শ্রীবৃদ্ধি হবে: এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো জাতি ভিত্তিক সমর্থন আদায়ে আগ্রহী হয়ে ওঠতে পারে, যা জাতিগত উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারে এবং সাধারণ রাজনৈতিক বিষয়গুলো জাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতে পারে।
কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি থেকে বিভ্রান্তি হবে: জাতিগত ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করা হলে বৃহত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে সমাজের মূল চাহিদাগুলি বাদ পড়ে যেতে পারে।
আনুষ্ঠানিক জটিলতা ও খরচ: জাতিগত গণনা পরিচালনা করা একটি বৃহৎ কর্মযজ্ঞ যা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হতে পারে।
এই বিতর্ক ও যুক্তি সমাজে চলমান। বৈষম্য ও উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে জাতির অবস্থান কীভাবে দেখা উচিত, সে বিষয়ে আলোকপাত করা আবশ্যক।
নির্মম হলেও সত্যি আমরা যারা ভারতবর্ষের নাগরিক, আমরা বুঝি, আমাদের দেশে যে জাত ব্যবস্থা হাজার হাজার বছর ধরে সমাজে চলমান। এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার জন্য বহু মনীষী চেষ্টা করেছেন কিন্তু এর শিখর এত গভীরে যে, একে নির্মূল করা কঠিন একটি কাজ। কেননা, এই ব্যবস্থাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সামাজিক ক্ষেত্রে এর এতটাই প্রভাব যে, ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ও সমাজ এই ব্যবস্থাকে নিয়ে অন্য ধর্মেও বয়ে নিয়ে চলেছে। তাই একথা বলা সঠিক হবে না যে, শুধু মাত্র হিন্দু ধর্মে এই ব্যবস্থা প্রতীয়মান। দেশের অন্যান্য ধর্মেও তা বিরাজমান। এর ফলে একশ্রেণীর মানুষ সমাজের মূল ক্রিম খেয়ে যাচ্ছেন আর একশ্রেণীর মানুষ অনাদিকাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই জাতি গণনা প্রক্রিয়া মাধ্যমে যদি সমাজ ও দেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়, তাহলে যে উপকারিতা আমরা দেখতে পাবো তা নিম্নরূপ।
জাতি ভিত্তিক জনগণনার উপকারিতা সমূহ:
১. রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে জাতি ভিত্তিক জনগণনার মাধ্যমে সঠিক পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা গ্রহণের সহজ রাস্তা উন্মোচিত হবে। জাতি গণনার মাধ্যমে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব হয়, যা দেশের বিভিন্ন অংশে কতজন মানুষ পিছিয়ে আছে, কতজন উন্নতির পথে রয়েছে এবং কতজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত, সেই তথ্যগুলি সরকারের হাতে তুলে দেয়। ফলে সরকার সহজেই কোনো বিশেষ শ্রেণীর জন্য উন্নয়নমুখী পদক্ষেপ নিতে পারে।
২. সরকারি চাকরিতে সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব
জনগণনা ও জাতি ভিত্তিক গণনা করা হলে সরকারি চাকরিতে এসসি, এসটি ও ওবিসি শ্রেণীর মানুষের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যাবে। বর্তমানে এই শ্রেণী গুলির অনেকেই সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জাতি ভিত্তিক তথ্য প্রদান করলে সরকারের জন্য এই শ্রেণী গুলির প্রতিনিধিত্বের নীতি গ্রহণ করা আরও সহজ হবে।
৩. সামাজিক সমতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা:
এসসি, এসটি এবং ওবিসি শ্রেণীর মানুষকে বহুদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। জাতি ভিত্তিক জনগণনা এই বৈষম্য নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়গুলির সঠিক পরিসংখ্যান ও পরিস্থিতি জানা গেলে, তাদের উন্নয়নে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে সমাজে সমতা ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৪. নীতিনির্ধারণে সহায়ক
সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণনার ভূমিকা অপরিসীম। এর মাধ্যমে সরকারের পক্ষে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য কী ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করা সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, এবং সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়। পিছিয়ে পড়া জনজাতি গুলির প্রতিনিধি যদি পরিকল্পনার মূল জায়গায় উপস্থিত থাকে, তাহলে সেই জনজাতির মূল সমস্যাগুলোকে রাষ্ট্রের কাছে উপস্থাপন করতে পারবে।
৫. অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির দিশা:
জাতি ভিত্তিক জনগণনার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। ফলে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এই শ্রেণীগুলির অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আমাদের দেশ চিরায়ত একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ও মানদণ্ড ধরে পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য একশ্রেণীর মানুষ প্রতিনিয়তই উন্নতি করেছে আর এক শ্রেণীর মানুষ পেছনে পড়ে রয়েছে।
৬. রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ:
জনগণনা ও জাতি ভিত্তিক গণনার মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রকৃত জনসংখ্যার তথ্য পাওয়া গেলে, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ বাড়ে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ তাদের সংখ্যানুপাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও মজবুত ও কার্যকরী করে তোলে। সামাজিক প্রতিষ্ঠার ফলে বিশেষ একটি শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার যে প্রবণতা তা হ্রাস পাবে।
উপসংহার
জাতি ভিত্তিক জনগণনা পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের প্রতিটি রাজ্যে পিছিয়ে থাকা শ্রেণীগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঠিক মূল্যায়ন করে তাদের উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। সরকারি চাকরি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের সুযোগ-সুবিধাগুলি জনগণের প্রকৃত অবস্থার ভিত্তিতে বিভাজন করা গেলে, সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচারের স্থায়ী প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাই, জাতি ভিত্তিক জনগণনার দাবি শুধু যুক্তিসঙ্গত নয়, এটি যেমন সময়োপযোগী তেমনি প্রয়োজনও বটে। এই প্রয়োজনীয়তা কথা ভেবে আজকের দিনে এই দাবি জোরদার হচ্ছে।
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct