১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে, যারা সংসদ বা বিধানসভায় গিয়ে দেশ পরিচালনার আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় আট দশক পার হলেও আজও আমরা “শাসক” ও “শাসিত” এই দুই শ্রেণীর ধারণার মধ্যে আবদ্ধ রয়েছি। লিখেছেন পাশারুল আলম...
গণতন্ত্র শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল “জনগণের দ্বারা শাসন।” যেখানে দেশের জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং জনগণের প্রতিনিধিরাই শাসন পরিচালনা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে, যারা সংসদ বা বিধানসভায় গিয়ে দেশ পরিচালনার আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় আট দশক পার হলেও আজও আমরা “শাসক” ও “শাসিত” এই দুই শ্রেণীর ধারণার মধ্যে আবদ্ধ রয়েছি। জেলা শাসক, মহকুমা শাসক প্রভৃতি শব্দাবলী এখনো প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বহুল প্রচলিত।
শাসক ও প্রশাসক: পার্থক্য ও বর্তমান অবস্থা:
স্বাধীনতার পরও “শাসক” শব্দটি ব্যবহার করা একটি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের জনগণকে শাসন করাই ছিল ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য। তখন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মূল কাজ ছিল শাসকের ভূমিকা পালন করা। কিন্তু স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এসব প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার কথা। তবুও, জেলা শাসক বা মহকুমা শাসক হিসেবে তাদের পরিচয় বহন করছে সেই পুরনো শাসন ব্যবস্থার মানসিকতা।
আজকের প্রেক্ষাপটে, গণতান্ত্রিক দেশে শাসকের মতো ভূমিকা পালন করা মোটেও কাম্য নয়। জনসেবা এবং প্রশাসন পরিচালনার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকা উচিত। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাজ হলো সরকারের নীতি ও আইন বাস্তবায়ন করা এবং জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু ‘শাসক’ শব্দটি ব্যবহারের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির সৃষ্টি হয়। এই মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন নতুন ধরণের চিন্তাভাবনা।
গণতন্ত্রে শাসকের ধারণার অপ্রাসঙ্গিকতা:
গণতন্ত্রে শাসক আর শাসিতের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকা উচিত নয়। জনগণই আসল ক্ষমতার অধিকারী, আর জনসেবকরা তাদের সেবা করার জন্য নিয়োজিত। কিন্তু যখন আমরা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের “শাসক” হিসেবে অভিহিত করি, তখন একটি মানসিক ফাঁক তৈরি হয় যা গণতন্ত্রের মূল আদর্শের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক দেশে শাসনের ধারণা নয়, বরং সেবার ধারণা বেশি গুরুত্ব পাবে। জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, এবং সেবা প্রদানই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি হওয়া উচিত।
পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা:-
১. প্রশাসনিক পদবীগুলোর পুনর্গঠন: প্রথমেই ‘শাসক’ শব্দটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার সাথে যুক্ত শব্দাবলী থেকে বাদ দেওয়া উচিত। এই পদবীগুলোর পরিবর্তে এমন পদবী নির্ধারণ করা দরকার যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২. মানসিকতার পরিবর্তন: শুধু নাম পরিবর্তন করলেই চলবে না, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে জনসেবার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। জনগণকে শাসন করা নয়, বরং তাদের সেবা করাই হবে প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য।
জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা: সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের জন্য জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। যাতে জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপিত হয় এবং গণতন্ত্রের সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।
উপসংহার:
গণতন্ত্রের মূলে রয়েছে জনগণের শাসন। জনগণের প্রতিনিধি এবং প্রশাসন সবাই মিলে জনসেবার মানসিকতায় কাজ করলেই প্রকৃত গণতন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব। ‘শাসক’ ও ‘শাসিত’ এর ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে একটি জনবান্ধব রূপ দেওয়াই গণতান্ত্রিক দেশের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct