মনিরুজ্জামান (বিটু), আপনজন: ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্নভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। মুসলিম বিদ্বেষী মানুষদের মানসিকতার কাছে ওয়াকফ সম্পত্তি সত্যিই ঈর্ষার কারণ। কেননা ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ সেনাবাহিনী এবং রেলের পরেই। যার পরিমাণ কয়েক কোটি একর। ২০২৪ পর্যন্ত ৯ লক্ষ একর অর্থাৎ ২৭ লক্ষ বিঘা ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধার হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিপুল সম্পত্তির উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে।
কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রী কিরেন রিজিজু (০৮-০৮-২০২৪ )সংসদের লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪ পেশ করেন। ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের উপর চল্লিশটি সংশোধনী আনা হয়। এই বিতর্কিত বিল পেশ করার পরে পরেই বিরোধীরা প্রবল সমালোচনায় মুখর হয়। কংগ্রেস নেতা হিবি ইডেন বলেন --” এই বিল সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা যা সংবিধানের ৩০০ এ ধারার পরিপন্থী।” মিম নেতা আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি স্পষ্ট বলেন--” এই বিল এনে বিজেপি সংসদে ঘোষণা করে দিল তারা মুসলমানদের বড় দুশমন। “ আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন-- ওয়াকফ বোর্ডের এই সংশোধন সংবিধানের ১৫,২৫,২৬,২৭,৩০,৩১ ৩০০ এ অনুযায়ী ধর্মীয় স্বাধীনতা বিরোধী।
তীব্র বিতর্কের পরে ২১ জন লোকসভা এবং ১০ জন রাজ্যসভার সদস্য নিয়ে গঠিত ৩১ জন সদস্যের জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি(JPC) বা যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করেন।, এই কমিটির সভাপতি করা হয় জগদম্বিকা পল কে। তারা একটা ওয়েবসাইট খুলেছে এবং সেখানে বলা হয়েছে, ওয়াকফ সংশোধনী বিল সম্পর্কে যারা পরামর্শ দিতে চান, তারা তাদের পরামর্শ জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে পাঠাতে পারেন। যেকোনো ব্যক্তি এনজিও বিভিন্ন সংস্থা ১৫ দিনের মধ্যে এই সংশোধনী বিলের উপর পরামর্শ দিতে পারেন।তবে কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। ইতিমধ্যেই JPC চেয়ারম্যান জগদম্বিকা পল বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন এবং পরামর্শ নিচ্ছেন। তিনি বলছেন সকলের পরামর্শেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু তার এই কথায় বিরোধীরা এমনকি মুসলিম সংগঠন গুলো আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের ধারণা কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ওয়াকফ সংশোধনী বিল এনে মূলত দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিকে কুক্ষিগত করতে চাইছে। জেপিসি এখন পর্যন্ত চারটি বৈঠক করেছে।প্রতিটি বৈঠকেই শাসক ও বিরোধীরা বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। সংসদ ভবন কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত জেপিসির চতুর্থ বৈঠকে সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনে থাকা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এএসআই)- এ অধিকারীরা বিভিন্ন ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। তারা জেপিসি সদস্যদের জানান পুরো দেশে ১৩২ টি সম্প্রতি নিয়ে ওয়াকফ বোর্ডের সঙ্গে বিরোধ আছে।এই পরিসংখ্যান তৎক্ষণাৎ ভুল প্রমাণ করেন আপ নেতা সঞ্জয় সিং। তিনি বলেন শুধুমাত্র দিল্লিতেই ১৭২ টি সম্পত্তি এএসআই দখল করে রেখেছেন। বিরোধী সদস্যরা বলেন এএসআই তাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এমনকি তারা কেন্দ্রীয় মোদি সরকারের অভিসন্ধিকে সফল করার জন্য অনুঘটকের কাজ করছে বলে বিরোধীরা দাবি করেন। জেপিসির এক বিজেপি সদস্য বলেন, ওয়াকফ বোর্ড ইসলামিক সংস্থা নয়। কারণ কোরআন শরীফে ওয়াকফ বোর্ডের উল্লেখ নেই। স্বাভাবিকভাবে ওই সদস্যের সঙ্গে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। জিপিসির বিজেপি সদস্যরা যুক্তিহীন যুক্তি খাড়া করে ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তগত করতে চাইছে।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডসহ সমস্ত স্তরের মুসলিম সংগঠন গুলো এই বিল প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।
ওয়াকফ মুসলমানদের দান করা নির্ভেজাল সম্পত্তি। ধর্মপ্রাণ মুসলমান তাদের কষ্টার্জিত সম্পত্তি মুসলমানদের বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের জন্য এবং পরকালে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ওয়াকফ করেন। আল্লার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত সম্পত্তিতেই মুসলমানদের মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, এতিমখানা, কবরস্থান, খানকা, দরগা, স্কুল, কলেজ, হসপিটাল এবং বিভিন্ন দাতব্য বিষয়ক ক্রিয়া কর্ম চলে। ভারতে এই ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি একর।এই বিপুল সম্পত্তি পরিচালনার জন্য সরকার কেবলমাত্র ওয়াকফ আইন প্রয়োগ করেছে। ওয়াকফ আইন ও ওয়াকফ সম্পত্তি ভারতীয় সংবিধান ও শরিয়া বলদত আইন ১৯৩৭ ধারা সুরক্ষিত। তাই সরকার ইচ্ছা করলেই এই সম্পত্তির মর্যাদা ও প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে পারে না।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরু সরকারের আমলে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ বোর্ড আইন প্রথম পাস হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা এবং বিধানকে সহজ করা। ১৯৬৪ সালে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের অধীনে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল (CWC) প্রতিষ্ঠিত হয়,যার মূল লক্ষ্য ছিল সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গুলিতে যে ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে সেগুলো কে পরামর্শ মূলক সহায়তা প্রদান করা। উল্লেখ্য এই মুহূর্তে দেশে প্রায় ৩০ টি ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডগুলোকে আরো বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালে আরও সংশোধন করা হয়েছিল, যা বিলটি ওয়াকফ বোর্ডগুলোকে সীমাহীন এবং নিরঙ্কুশ স্বায়ত্তশাসন দিয়েছে। যার ফলে ওয়াকফ বোর্ড গুলি ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনা করা,হারানো সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা, প্রয়োজনে বিক্রি করা বা লিজের মাধ্যমে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর অনুমোদন করতে পারে,। ওয়াকফ সম্পত্তির ইতিহাস বহু পুরানো। সুলতানি এবং মুঘল যুগ থেকে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ওয়াকফ আইন প্রণয়ন করেন। ভারতের ওয়াকফ বোর্ড গুলি মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবন নিয়ে কাজ করে।
নতুন ওয়াকফ বোর্ড সংশোধনী বিল নিয়ে আসার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বিজেপি সরকারের মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতা তাদের এই সংশোধনী বিল আনতে বাধ্য করেছে। বেশ কয়েকটি ওয়াকফ সম্পত্তি, যেগুলো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ওয়াকফ সম্প্রতি বলে মেনে নিতে চায় না। সেগুলো তারা ছলে বলে কৌশলে দখল করতে চাই। তাই বিল সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বারানসির মসজিদ, মথুরার ঈদগাহ, মধ্যপ্রদেশের কামাল মৌয়া মসজিদ ইত্যাদি। এছাড়াও লক্ষ লক্ষ একর ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখল হয়ে রয়েছে,মামলা মোকদ্দমা অর্থাৎ আইনি সমস্যার রয়েছে কয়েক লক্ষ ওয়াকফ সম্পত্তি।সরকার এই সমস্ত সমস্যার সমাধান কল্পে কোন সংশোধনী নিয়ে আসেনি।
শিখদের রয়েছে ‘গুরুদুয়ারা আইন ‘(১৯২৫) যেখানে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারেনা। এমনকি অন্য কোন সম্প্রদায়ের মানুষ ওই বোর্ডের সদস্য হতে পারে না। মুসলিমদের দীর্ঘদিনের দাবি ওয়াকফ সম্পত্তি গুলোকে ১৯২৫ গুরুদোয়ারা আইনের ভিত্তিতে গঠিত হোক, যাতে সরকার হস্তক্ষেপ করতে না পারে। একইভাবে হিন্দুদের রয়েছে এনডাওমেনট বোর্ড, সেখানে কোন অহিন্দু সদস্য থাকতে পারে না। এছাড়াও পাঞ্জাবি খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের ধর্মীয় সম্পত্তি,উপাসনালয় ইত্যাদি পরিচালন বোর্ড বা কমিটিতে দেশের কোথাও মুসলিম প্রতিনিধি রাখা হয় না।তাহলে মুসলিমদের দান করা ওয়াকফ সম্পত্তিতে হিন্দু সদস্য থাকবে কেন ?
কেন্দ্রের সংখ্যালঘু মন্ত্রী কিরেন রেজিজু যে সংশোধনী বিল নিয়ে এসেছে,তাতে যে সংশোধন গুলো রয়েছে, তন্মধ্যে কয়েকটি হলো -ওয়াকফ বোর্ড দাবি করলেই হবে না, সেগুলি ভালোভাবে যাচাই করার প্রয়োজন আছে। বোর্ডে মহিলা প্রতিনিধি রাখতে হবে। বোর্ডে অমুসলিম সদস্য দুজনকে রাখতে হবে। যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ রয়েছে সেগুলোর নতুন করে যাচাই করতে হবে। ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা থাকবে। যে সংশোধনীগুলি আনা হয়েছে সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখলেই তাদের অভিসন্ধি পরিষ্কার বোঝা যায়। ওয়াকফ বোর্ড গুলির নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে খর্ব করে ম্যাজিস্ট্রেট হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চাইছে।
ভারতের কোন মুসলিম সংগঠন এই ধরনের সংশোধন মানতে পারবে না। এমনকি বিরোধী রাও এই সংশোধন মানতে রাজি নয়। তারাও প্রবলভাবে এই সংশোধনী গুলোর উপর সমালোচনার মুখর হয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আল্লাহর নামে উৎসর্গকৃত মুসলমানদের সম্পত্তি গ্রাস করার অভিসন্ধি করছে বর্তমান সরকার। কেননা এটা ধর্মীয় শরিয়া বলদত আইন (১৯৩৭)এবং সংবিধান বিরোধী। এই বিল আইনে পরিণত হলে সারা দেশে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে মিথ্যা মামলা ও জমি দখলের কেস শুরু হয়ে যাবে। আর জমি মাফিয়ারা ঝাঁপিয়ে পড়বে মূল্যবান সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার জন্য। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হবে। ওয়াকফ সম্পত্তি জবর দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। তাই দেশের অখন্ডতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে।সংবিধান স্বীকৃতি ধর্মীয় অধিকারকে টিকিয়ে রাখতে, ওয়াকফ সম্পত্তিকে রক্ষা করতে, ভারতের সর্বস্তরের শান্তি প্রিয় মানুষকে এক বাক্যে এই ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে ,যতদিন না এই বিল প্রত্যাহার করা হয়।
** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct