সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনজন: আমার ছেলে তখন বাড়ি ছিল না। ছেলের বন্ধু, ২৪-২৫ বছরের ৪ জন যুবক আমাদের বাড়িতে এসে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা প্রত্যেকেই বি.টেঁক অথবা এম.এসসি.পাস এবং বিভিন্ন নামী সংস্থায় সম্মানীয় পদে চাকরি করে। ওরা যেখানে বসেছিল তার পাশেই একটা খোলা সেলফে অনেক বই এবং ম্যাগাজিন রাখা ছিল। ওগুলো না দেখে ওরা প্রত্যেকেই মোবাইল ফোনে আঙুল ঘষে চলছিল। চারটি ম্যাগাজিন ওদের কাছে দিয়ে ওদের বললাম,” প্রত্যেকে অন্তত যেকোনও একটা করে খুব ছোট গল্প, প্রবন্ধ বা অন্য কিছু পড়,অনেক কিছু জানার জিনিষ আছে ” । আমি ওখান থেকে চলে গেলাম। ১০-১২ মিনিট পর ফিরে এসে দেখলাম,ওরা সেই যথাপূর্বম মোবাইলই ঘেঁটে চলেছে। একটু অসন্তুষ্ট মনেই ওদের বললাম, “ বইগুলো তোরা কেউ দেখলি না “? ওদের একজন বলল, “ কাকু, এসব আজকাল কেউ দেখে না,তবু শুধুমাত্র তোমার কথা রাখতে আমরা সবাই এগুলো ভালো করে উল্টে-পাল্টে দেখেছি কিন্তু ওগুলোর মধ্যে কিছু নেই “। আরেকজন বলল,“ আজকাল প্রায় সবাই বলে যে,সাহিত্য পড়ে কোনও লাভ নেই, বরং বিজ্ঞান আর বাণিজ্য পড়লে লাভ আছে , মানুষের যত উন্নতি তো বিজ্ঞানই করেছে ”।
এই ছেলেগুলোর কোনও বিক্ষিপ্ত চরিত্র নয়, অনেক মানুষই বলেন যে,বিজ্ঞানের উন্নতিতেই নাকি মানুষের সমাজে এত উন্নতি ,মানুষ আজ সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেছে ,এখানে সাহিত্যের কোনও অবদানই নেই। একথাও বলতে শোনা যায় যে ,সাহিত্য পড়া বাদ দিয়ে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ইত্যাদি পড়ানো হোক।এই ধারণা কি আদৌ ঠিক ?
এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, আদিম যুগে বাঘ, সিংহ,শিয়াল, ভল্লুক ইত্যাদি চতুষ্পদ বন্য জন্তুর মত মানুষও উলঙ্গ হয়ে বনের মধ্যে চরে বেড়াত। খাদ্যের প্রয়োজনে হরিণ,খরগোশ,ভেড়া,শূয়োর ইত্যাদি প্রাণী মেরে তাদের কাঁচা মাংস খেত। তাছাড়া বনের ফল,মূলাদিও খেত। বন্য প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের কোনও তফাৎ ছিলনা। পাশাপাশি ঐসব জন্তু-জানোয়াররাও যেমন নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি, মারামারি এবং কামড়া-কামড়ি করে একে অপরকে রক্তাত্ব করে দিত,মানুষও সেইরকমই করত। কিন্তু,কিছু মানুষের মগজ নিঃসৃত একের পর এক আবিষ্কারে মানুষ অনেক কিছু শিখেছে,যেগুলো বন্য জন্তুদের থেকে মানুষকে আলাদা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে , মানুষ ক্রমে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে।সেইসঙ্গে পারস্পরিক ভালবাসা এবং বিপদে পাশে থাকার বিভিন্ন কাহিনী মানুষের ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগিয়েছে ,মনে এনেছে শৃঙ্খলারবোধ। বিজ্ঞান যেমন মানুষকে দিয়েছে প্রযুক্তিগত উন্নতি ,পাশাপাশি সাহিত্য দিয়েছে এই বন্য মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে,উন্নত মননের দিশা।
বীরত্বের বিভিণ্ণ গাঁথা মানুষকে সাহস জুগিয়েছে। বহু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সাহিত্যিকদের কলম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে।ভারতবর্ষে বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ , দ্বিজেন্দ্র লাল রায় প্রমুখ আরও অনেক কবির কলম থেকে ঝরে পড়া বিদ্রোহী লেখনী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রবলভাবে লড়াইের ময়দানে মানসিক শক্তি জুগিয়েছে। ধর্মীয় বিভেদকে দূরে সরিয়ে রেখে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস.ওয়াজেদ আলি সাহেবের বিভিন্ন রচনা।
সাহিত্য হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। মনে পড়ে, তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। ক্লাসে একদিন একজন মাষ্টারমশাই একটা গল্প বললেল। গল্পটা ছিল, ইউরোপ বা আমেরিকার কোনও এক দেশে একজন মানুষ সমাজের কাছ থেকে প্রচণ্ড নির্যাতিত হচ্ছিলেন। আত্মহত্যা করার আগে তাঁর মনে হল,” আত্মহত্যা না করে বরং আমার বিরুদ্ধে হওয়া এইসব অত্যাচারের কাহিনী আগামী দিনের মানুষের জন্য লিখে রেখে যাই ,মানুষ এর থেকে শিক্ষা নেবে”।আত্মহত্যা না করে তিনি সেগুলো লিখতে শুরু করলেন। এই কাহিনী আমাদের ক্লাসের “ নীরেন” নামের ১৩ বছরের একটি ছেলেকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে এনেছিল। নীরেনের ঘটনাটা খুবই শিক্ষণীয়। নীরেনের বাবা-মায়ের মধ্যে যথেষ্ট মিলমিশ ছিল। কিন্তু নীরেনের ওপর তার অত্যন্ত উচ্চ-শিক্ষিত,ধনী এবং অভিজাত বাবা-মায়ের ছিল অতিরিক্ত শাসন ও বিধিনিষেধ ,যেগুলো নীরেনের মত একটা ছোট ছেলের পক্ষে ছিল প্রচণ্ড কষ্টদায়ক এবং অসহনীয়।বাবা-মায়ের দেখে আরও অনেকে নীরেনকে অযথা বকাবকি করত, যেটা আমাদের দেশের বহু মানুষেরই স্বভাব। বাস্তবে এই ঘটনাটি প্রচণ্ডভাবে আমার মনে দাগ কেটেছিল।
উপযুক্ত কাহিনী অনেক সময় সমস্যা জর্জরিত মানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম এবং অর্থাভাবের সমস্যায় পড়া কোনও কোনও মানুষকে সাহিত্যই দিয়েছে মনের জোর, দেখিয়েছে পথের দিশা।
কারাগার,পাগলা-গারদ ইত্যাদি বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ ও গল্প সে’সব জায়গায় বন্দি মানুষের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরে সংবেদনশীল মানুষকে তাদের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়েছে ,তাদের বিষয়ে ভাবার প্রবণতা এনেছে।আসলে সাহিত্য হল লেখকের মনের সুক্ষ অনুভূতির প্রকাশ এবং অন্যের অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলার একটা বড় মাধ্যম।
তাছাড়া, বিনোদনের জগতেও যে’সব সিনেমা, নাটক ইত্যাদি মানুষ দেখে, সেগুলোও তো সাহিত্য-সৃষ্ট কাহিনীর ওপরই নির্মিত।এইভাবে সাহিত্য মানুষকে অনেক কিছুই দিয়েছে, যার আয়তন বিশাল ,মূল্য অনেক। অতএব মানুষের উন্নতিতে এবং সুস্থ সমাজ চালনায় সাহিত্যের কোনও অবদান নেই , ধারনাটা চরম ভুল বরং উন্নত মানসিকতা গড়তে এবং সুস্থ সমাজ চালনায় সাহিত্যের ভুমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct