নুরুল ইসলাম খান, কলকাতা, আপনজন: মঙ্গলবার কলকাতার মৌলালির কাছে মায়রা সভাঘরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের ওয়াকফ সুরক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। উপস্থিত হয়েছিলেন মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের শীর্ষ নেতৃত্ব ছাড়াও এ রাজ্যের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের কর্ণধাররা। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সম্মেলনের সূচনা হয়। উর্দু ভাষায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য তথা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সেন্টারের চেয়ারম্যান মাওলানা মুহাম্মদ আবু তালিব রহমানী। বাংলায় স্বাগত ভাষণ দেন জমিয়তে উলামা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক ক্বারী শামসুদ্দিন আহমেদ।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতি মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দেশের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জীবনে কঠিন একটি কলো দিন আসতে চলেছে। সমস্ত প্রমাণ থাকার পরও বাবরি মসজিদ যেমন করে শহিদ হল। ঠিক সেই রকমভাবে ওয়াকফ সম্পত্তির বিষয়টিও মুসলমানদের হাতছাড়া হতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের হাতে কোন ক্ষমতা নেই। তবে ঈমান ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার মতো আমাদের হাতে ক্ষমতা আছে। সেটাকেই পাথেয় করে সমগ্র মুসলিম সমাজকে আন্দোলনে শামিল হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ সম্পত্তি আমাদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া, কেউ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। ওয়াকফ সংশোধনী বিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ও সংবিধান পরিপন্থী। সরকারকে এই বিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় আমরা প্রতিটি গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করব, প্রয়োজনে দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজপথে নামার আহ্বান জানান তিনি।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ ফজলুর রহিম মুজাদ্দিদি বলেন, সরকার মুসলমানদের উপেক্ষা করে বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে একটি অসাংবিধানিক বিল আনছে। এটা আমাদের বিশ্বাস ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আমাদের বাড়িঘরে বুলডোজার চালানো হচ্ছে। এখন আমাদের মসজিদে, ইসলামের আচার-অনুষ্ঠানের ওপর বুলডোজার চালানো হবে, তা আমরা নিশ্চয়ই সহ্য করব না। এই জাতি উঠে দাঁড়াবে এবং সরকার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। আমরা এগিয়ে যাব এবং রাজপথে নামব, তবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মুখপাত্র ড. কাসেম রসূল ইলিয়াস বলেন, সংসদীয় যৌথ কমিটির কাছে ইতিমধ্যে সাড়ে ৮৫ লক্ষ কমিশনে ওয়াকফ সংশোধনী বিল বিরোধী ই-মেইল পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে শুধুমাত্র পঁচাত্তর লক্ষ মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড পাঠিয়েছিল। এখন গোটা উম্মাহ রুখে দাঁড়িয়েছে। এটা যথেষ্ট সান্ত্বনাদায়ক, কিন্তু আপনারা যদি এগিয়ে না আসেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী তথা জাকাত ফাউন্ডেশনের কর্ণধার সৈয়দ জাফর মেহমুদ বিলটির ত্রুটিগুলির উপর বিশদ আলোকপাত করেছেন এবং প্রতিটি পয়েন্ট স্পষ্ট করেন। বিস্তারিত জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার খতম করতে চায় ওয়াকফ সম্পত্তি। আমাদের ওযাকফ সম্পত্তিতে অমুসলিমদের নিয়োগ নিয়ে এই বিলে বেশ কিছু ধারা রয়েছে যা মুসলিমদেরকে এস্টেট থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে। ওয়াকফ বোর্ডের এগারো সদস্যের মধ্যে মাত্র চারজন হবেন মুসলিম। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন যে আমরা ওয়াকফ কমিটিতে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব দিচ্ছি। সরকারের এই বিলটি বিভ্রান্তিকর। কারণ, দুই মহিলার অন্তর্ভুক্তি ইতিমধ্যেই অনুমোদিত, এটা নতুন কিছু নয়। তাই ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালে একজন মুসলিম বিশেষজ্ঞ থাকা দরকার ছিল। এই বিলটি ওয়াকফ এবং সাংবিধানিক অধিকার হরণকারী।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য ও অল ইন্ডিয়া কাউন্সিলের জাতীয় সহ-সভাপতি মাওলানা আনিসুর রহমান কাসমি বলেন, দান আমাদের বিশ্বাসের সাথে জড়িত। মসজিদ বা অন্য প্রতিষ্ঠান যাই হোক না কেন, সেগুলিও দান। কাজেই এটা ভাবা উচিত নয় যে ওয়াকফ শুধুমাত্র আয়ের সাথে সম্পর্কিত, এটি ইসলামের আচার-অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত, যা রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য ও আল করিম ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ডক্টর আহমদ আশফাক করিম স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করার জন্য মাওলানা আবু তালিব রহমানীর প্রশংসা করে বলেন, আজকের সম্মেলনের প্রভাব সারা দেশে এবং কলকাতায় অনুভূত হবে। সমগ্র দেশে একটি মহান বার্তা যাবে যে যে বিলটি প্রস্তাব করা হচ্ছে তা মুসলিমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমিরাত শরিয়া পাটনার ট্রাস্টি মাওলানা জাফর আবদুল রউফ রহমানি তার আবেগঘন ভাষণে বলেছেন যে আমরা একটি জীবন্ত জাতি এবং আমাদের গণতন্ত্রে টিকে থাকতে হলে আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে। , আমাদের বিলাসিতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং আমাদের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করতে হবে, অন্যথায় আমাদের প্রজাতি বিলুপ্ত হবে।
রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী তথা জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের রাজ্য সভাপতি মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমরা এই সভাটি খোলা মাঠে করতে পারতাম। কিন্তু কম সময়ে সভাটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে করতে হতো তাই আমরাও মাঠে জড়ো হব। এই বৈঠকে আরও ঘোষণা করা হয়েছে, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড আগামী ৬ অক্টোবর ঝাড়খণ্ডে ওয়াকফ সুরক্ষার বিষয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করবে।
এদিন অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, মাওলানা মারুফ সালাফী (জমিয়তে আহলে হাদিস), জামায়াতে ইসলামী সার্কেলের আমির ডা. সাইউর রহমান, মাওলানা নাজ মীমুদ্দিন কাসমি (কনক, ওড়িডিশা), মুহম্মদ কামরুজ্জামান, হাজি সাউদ আলম, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct