মিসবাহুল হক, কলকাতা, আপনজন: কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে তৃণমূল শাসনামলে দেওয়া ওবিসি শংসাপত্র বাতিল হওয়ায় রাজ্যের ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি কিংবা চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে চরম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গত ২২ মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার ডিভিশন বেঞ্চ এক রায়ে জানিয়ে দেয়, ২০১১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত রাজ্যের প্রদান করা সমস্ত ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করা হল। যদিও হাইকোর্ট জানায় ২০১০ সালের আগের নথিভুক্ত ওবিসি তালিকা বহাল থাকছে। এছাড়া হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, এতদিন যারা ওবিসি সংরক্ষণ তালিকায় চাকরি পেয়েছেন বা নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই পুরনো সংরক্ষণ তালিকায় চাকরি পাবেন।
কলকাতা হাইকোর্টের এই রায়ের পর মুশকিলে পড়েছে ওবিসি এ ও ওবিসি বি তালিকাভুক্তরা। এই ওবিসি এ তালিকাভুক্তদের বেশিরভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের আর ওবিসি বি তালিকাভুক্তদের বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। সব মিলিয়ে দুই সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা বিশেষত চাকরির আবদেন ও বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে চরম বিপদের মধ্যে পড়েছেন। যদিও রাজ্যের কিছু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে হলফনামা জমা দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। তবে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখে ডাক্তারি কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে।
সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট-এ উত্তীর্ণদের মেরিট অনুযায়ী রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে এমবিবিএস, বিডিএস, আয়ুষ প্রভৃতি কোর্সে ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। ওয়েস্টবেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সেলিং কমিটি ইতিমধ্যে প্রথম রাউন্ড কাউন্সেলিংয়ে সফল আবেদনকারীদের প্রভিশনাল তালিকা প্রকাশ করেছে। এই প্রথম রাউন্ডের কাউন্সেলিংয়ের জন্য আবেদন করার শেষ তারিখ ছিল ২৩ আগস্ট। রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে অন্যান্য তথ্য জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাধ্যতামূলক ছিল কেন্দ্রীয় ওবিসি তালিকাভুক্তদের নন ক্রিমিলেয়ার সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার। ভর্তি প্রক্রিয়ার নিয়মাবলিতে উল্লেখ করা হয়, সংরক্ষণের আওতাভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের তাদের অায় সম্পর্কিত ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল বা তার পরের নন ক্রিমিলেয়ার সার্টিফিকেট জমা করতে হবে। জমা না করতে পারলে তাদেরকে জেনারেল ক্যাটেগরিতে স্থানান্তর করা হবে। ইউজি নেট পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সেই মতো নিট উত্তীর্ণ বহু ছাত্রছাত্রী নন ক্রিমিলেয়ার সার্টিফিকেট পেতে সংশ্লিষ্ট মহকুমা শাসকের দফতরে যান। কিন্তু সেই শংসাপত্র না পেয়ে বিপদের মধ্যে পড়েছেন। এর মূলে কলকাতা হাইকোর্টের ওবিসি বাতিল রায়। সংশ্লিষ্ট এসডিও অফিস থেকে ফেরানো হচ্ছে ওবিসি শংসাপত্রের আবেদনকারীদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু কলকাতা হাইকোর্ট তার রায়ে পরিষ্কারভাবে বলেছে, নিয়োগ বা ভর্তি প্রক্রিয়া চলাকালীন ২০১১ সালের পর পাওয়া ওবিসি শংসাপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে না। এছাড়া, ২০১১-র আগের ওবিসি তালিকাভুক্তদের শংসাপত্র যোগ্য বলেও কলকাতা হাইকোর্ট পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। যদিও রাজ্যের সংখ্যালঘুরা আশায় দিন গুনছিল হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ মিলবে। তা মেলেনি। বরং শুনানির দিন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশেষত এ বছর ডাক্তারি কোর্সে ভর্তির জন্য ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা পেতে শুধু রাজ্যের ওবিসি তালিকাভুক্ত হলে হবে না, কেন্দ্রীয় ওবিসি তালিকাভুক্ত হতে হবে। আর কেন্দ্রীয় ওবিসি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজ্যের যেসব ওবিসিভুক্তরা কেন্দ্রীয় তালিকায় রয়েছে তারা সবাই প্রায় ২০১০ সাল বা তার আগের। কিন্তু তারাও নিজ নিজ নিজ মহকুমা শাসকের দফতরে এনসিএল শংসাপত্র পাওয়ার আবেদন জানালেও পাচ্ছেন না। সূত্রের খবর, কলকাতা হাইকোর্টের রায় মেনে মালদা কিংবা বসিরহাটের মহকুমা শাসকের দফতর থেকে ২০১০ বা তার আগের ওবিসি তালিকাভুক্তদের এনসিএল শংসাপত্র মিললেও মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর মহকুমা শাসকের দফতর থেকে শংসাপত্র মিলছে না বলে অভিযোগ। রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলা মুর্শিদাবাদের পশ্চাদপদ ওবিসি সম্প্রদায়ের বহু কৃতী ছাত্রছাত্রী এনসিএল সার্টিফিকেট না পাওয়ায় মেডিক্যালের প্রথম কাউন্সেলিংয়ে জমা করতে পারেনি বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। তাদের জেনারেল ক্যাটেগরিতে আবেদন করা ছাড়া গতি নেই। এর ফলে, তার ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ।
এ ব্যাপারে মুর্শিদাবাদের সুতি থানা এলাকার হাতিলদা গ্রামে বাসিন্দা তরিকুল ইসলামের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নিট-এ ৬০১ নম্বর পেয়ে আয়ুষ কোর্সে ভর্তির আবেদন জানিয়েছেন তরিকুল। কিন্তু মেডিক্যাল কাউন্সেলিংয়ে এনসিএল সার্টিফিকেট জমা করতে পারেননি। তার ওবিসি শ্রেণি হল ‘পেঁচি’। ২০১০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ সরকার নোটিফিকেশনে ‘পেঁচি’ সম্প্রদায়কে ওবিসি এ তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু তরিকুল জঙ্গিপুর মহকুমা শাসকের দফতর থেকে এনসিএল সার্টিফিকেট না পাওয়ায় তাকে সাধারণ ক্যাটেগরিতেই আর্জি জানােতে হয়েছে। এই সু্িবধা বঞ্চিতদের তালিকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম পড়ুয়ারা। কারণ, ওবিসি এ তালিকাভুক্তদের বেশিরভাগ মুসলিম, তেমনি ওবিসি বি তালিকায়ও বেশ কিছু মুসলিম আছে। তবে, কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের ফলে ওবিসি বি তালিকায় থাকা সিংহ ভাগ হিন্দু ছাত্রছাত্রীরাও ক্ষত্রিগ্রস্ত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২৭ আগস্ট ওয়েস্টবেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সেলিং কমিটি প্রথম রাউন্ডের কাউন্সেলিংয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে।
সেই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ বছর রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে রাজ্যের কোটায় সাধারণ বিভাগে ১৬৯৯টি আসন। তার মধ্যে মুসলিমরা তাদের মেরিট অনুযায়ী স্থান পেয়েছে ৫৬৭জন। এর মধ্যে মুসলিমরা যেমন সাধারণ ক্যাটেগরিতে আছে তেমনি ওবিসি এ ও বি ক্যাটেগরিতেও আছে। ১৬৯৯ আসনের শেষ অল ইন্ডিয়া ব়্যাঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ৩৬৪৮৯। সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ওবিসি এ তালিকায় আসন সংখ্যা ৩৯৩ আর ওবিসি বি আসন সংখ্যা ২৭৬টি। এছাড়া ওবিসি এ পিডব্লুডি ১৫টি ও ওবিসি বি পিডব্লুডি ৯টি আসন। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ইএসআই হাসাপাতাল জোকায় রাজ্যের কোটায় ১০টি ওবিসি আসন রয়েছে।
তাই সব মিলিয়ে মোট ৭০৩টি আসন ওবিসির। শুধু ওবিসি এ এবং ওবিসি এ পিডব্লুডি মিলিয়ে ৪০৮টি আসন। এর মধ্যে ওবিসি এ তালিকায় বেশিরভাগ মুসলিম আর ওবিসি বি তালিকায় বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায়। তাই, ওবিসি শংসাপত্র না পাওয়ার কারণে কমে যেতে পারে এ বছরের মুসলিম ডাক্তারি পড়ুয়ার সংখ্যা। ওবিসিদের সাধারণ ক্যাটেগরিতে রূপান্তরিত করলে এবছর মুসলিম ডাক্তারি পড়ুয়ার সংখ্যা হাজার নাও পেরতে পারে। রাজ্যে মেডিক্যাল কাউন্সেলিংয়ের প্রথম তালিকার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে সেই চিত্র ফুটে উঠছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct