অধ্যাপক দীপক রঞ্জন মন্ডল, আপনজন: শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষকের সব থেকে বড় পরিচয় হলো তাঁর আচার-আচরণ, ব্যবহার, এক কথায় বলা যায় শিক্ষক সুলভ ইমেজ। একজন শিক্ষার্থী সব সময় একজন শিক্ষককে দেখতে চায় আদর্শ হিসেবে। শিক্ষক সবকিছু জানেন, এমন ভাব তাঁর কখনোই করা উচিত নয়। বরং শিক্ষক যদি তাঁর ছাত্রদের বলেন, আজকের ক্লাস থেকে আমি তোদের কাছ অনেক কিছু শিখতে পারলাম, বেশ কয়েকটা নতুন পয়েন্ট জানলাম। তাহলে শিক্ষার্থী অনেক বেশি উৎসাহিত হবে, উদ্বুদ্ধ হবে। কোনো বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের কিউরিওসিটি জন্মিয়ে ক্রিয়েটিভ এবং ক্রিটিকাল থিংকিং-এ উন্নীত করাই শিক্ষকের কাজ।
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল ছাত্রের মনে সৃজনশীল কাজ আর জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আর আনন্দ জাগ্রত করা।
মনে রাখতে হবে হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান হয় না, শিক্ষার্থীও তেমনই সকলে একই ধরনের হবে, এটা মনে করা ভুল। কেউ একটু ধীরে শেখে, আবার কেউ অতি দ্রুত, আবার কেউ বা মাঝারি, এটাই তো স্বাভাবিক।
ধীর গতির শিক্ষার্থীদের নিয়েই হয় সমস্যা। অনেক সময়েই শিক্ষকরা বলে ফেলেন, এই সহজ পড়াটা পারলি না, তোর দ্বারা কিছু হবে না। শিক্ষকের এরকম আচরণ কিন্তু ওদের আরো অনেকটা পিছিয়ে দেয়, আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। মনে রাখতে হবে, ওদের এই পিছিয়ে পড়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। যেগুলির দায় হয়তো বা ওই ব্যক্তি-ছাত্রের ওপর খুব একটা বর্তায় না। পারিবারিক দারিদ্র্য, দীর্ঘ অসুস্থতা, বিভিন্ন কারণে স্কুলে অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে তার এই পশ্চাদপদতা। এই সমস্ত দিক মাথায় রেখে শিক্ষক যদি ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে যান, একাত্ম হন, কাছে টেনে নেন, তার অসুবিধের প্রতি সমব্যথী হন, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর একটা আত্মিক যোগাযোগ গড়ে উঠবে, সক্ষতা তৈরি হবে। এটা কে সযত্নে লালন করলে ওই ছাত্রটি তার প্রিয় শিক্ষকের জন্য অনেক কিছু করতে রাজি হবে। অনেকটা কষ্ট করে হলেও পড়াশুনাতেও মন দেবে।
এগিয়ে থাকা বা মাঝারি মানের শিক্ষার্থীদের জন্য খুব একটা চিন্তার নেই। পাঠ্যের মধ্যে থেকে প্রশ্ন করতে করতে পাঠ্যের বাইরে চলে যাওয়া, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পড়াশোনার মিল খুঁজে পেলে ওরা অনেক প্রশ্ন করতে শুরু করবে। এমনকী ধীরগতি সম্পন্ন ছেলেরাও। ওদের করা প্রশ্নের উত্তর ওরাই খুঁজুক শিক্ষক শুধু মাঝেমধ্যে ধরিয়ে দেবেন। এতেই কাজ হবে।
এমনও হতে পারে, ওদের করা প্রশ্ন কিংবা প্রশ্ন করতে করতে আপনি এমন একটা প্রশ্ন করেছেন যার উত্তর আপনারই জানা নেই। আপনি সেটা কখনো লুকোবেন না, পরিষ্কার বলুন এর উত্তর তোমরাও খোঁজো, আমিও খুঁজছি, পরে আলোচনা করা যাবে।
ওদের পারফরমেন্সকে সবসময় অ্যাপ্রেসিয়েট করুন। এমনকী মাঝেমধ্যে ওদের কাছে শিক্ষক হেরে যাওয়ার ছলনাও করতে পারেন। আসলে ক্লাসে গতি বজায় থাকবে কীভাবে, শিক্ষার্থী সার্বিক উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে সজাগ হতে হবে শিক্ষককেই। চোখ-কান খোলা রেখে নতুন ভাবনা, নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। দিন বদলাচ্ছে, ধাঁচ তো বদলাবেই।
মনে রাখতে হবে ছাত্র আছে বলেই শিক্ষকের অস্তিত্ব। পড়াশোনায় শিক্ষার্থীরা যত উৎসাহ নিয়ে ভরিয়ে তুলবে শিক্ষাঙ্গন, ততই শিক্ষকের জয়জয়কার।
অনুলিখন : নায়ীমুল হক
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct