মেচবাহার সেখ, আপনজন: উপক্রমনিকা: শিশুরা ছোট বয়স থেকে কীভাবে কথা বলা শিখবে, পড়া শিখবে এবং লেখা শিখবে - এ বিষয়ে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই পৃথিবীর নানা মনীষী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিকগণ এ বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত কী ভাবনা, তত্ত্ব ও বাস্তবতা আমাদের জন্য রেখে গেছেন সেগুলো দিয়ে শুরু করলে আমাদের জানা ও বিশ্বাসটা বোধহয় মজবুত হয়। কারণ আমরা সীমিত জ্ঞানের মানুষ।
প্রথমে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শুরু করা যাক। তিনি তাঁর ‘ধর্মশিক্ষা’ প্রবন্ধের এক জায়গায় বলছেন – “একটা পাথরকে দেখাইয়া বলিতে পারো ইহাকে যেমনটি দেখিতেছি ইহা তেমনই, কিন্তু একটা বীজ সম্পর্কে সে কথা খাটে না। তাহার মধ্যে এই একটি আশ্চর্য রহস্য আছে যে, সে যেমনটি তাহার চেয়ে অনেক বড়। ” বটবৃক্ষের ক্ষুদ্র বীজ আর তার সমতুল একটি পাথরকুচি সমান নয়। বটবীজের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছটি ঘুমিয়ে আছে। আমাদের শিশুরাও ঠিক তাই। সদ্যোজাতকে যেমনটি দেখি সেই দেখার মধ্যে তার বৃহত্তমটা দেখা যায় না। তাকে পরিচর্যা করলেই সে তার বৃহত্তম রূপটা দেখাতে পারে। যেমনটি বীজের পরিচর্যা করলে বৃহৎ বটগাছটিকে পাই।
শিশুকে পরিচর্যা ও তৈরি করতে অর্থাৎ তার শেখা, বলা, লেখা কেমন ভাবে হবে তা প্রথমেই শুরু হয় মায়ের কোলে। তারপর ক্রমান্বয়ে পরিবার, বৃহত্তর সমাজের নানা শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। সুতরাং দায় রয়েছে নানা স্তরে।
এই শিখন প্রক্রিয়াটা বুঝতে আবার এক মনীষীর সাহায্য নেওয়া যায়। তিনি হলেন রুশ দেশের বিশ্বখ্যাত শিক্ষা গবেষক লেভ সেমিওনভিচ ভাইগোৎস্কি। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি যে তত্ত্বের অবতারণা করলেন তার পরিচিত নাম হল Theory of Constructivism বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘জ্ঞান গঠনের তত্ত্ব’। জ্ঞান গঠন তত্ত্বের মূল কথা হল–শিখন বা শেখা একটি প্রক্রিয়া (লার্নিং ইজ এ প্রসেস)। শিশু শেখে একটা জ্ঞানের উপর ভর করে আরেকটা জ্ঞান। প্রতি মুহূর্তে শেখে। দেখে শেখে, শুনে শেখে। এটা একটা নৈমিত্তিক প্রক্রিয়া ( informal social process)। যা বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া নয় ( formal process)। আমি, আপনি না শেখালেও, না দেখালেও সে নিজের মতো করে সমাজ থেকে দেখে শুনে তার মতো শিখবে। এ শেখা আটকানো যাবে না। কিন্তু আমরা কি চাই? শিশু যা কিছু শিখুক, যা কিছু দেখুক এবং তার মতো ভাবুক বলুক? তাহলে তো তাকে সমাজের মতো, পরিবারের মতো, রাষ্ট্রের মতো তৈরি করা হল না। বর্ষাকালে আগাছা বা লতাপাতার মতো বেড়ে উঠলো। এটা তো কাম্য নয়।
আমরা চাই শেখার জন্য কাম্য মানের শিক্ষা। সেটা বলার ক্ষেত্রে, শেখার ক্ষেত্রে, লেখার ক্ষেত্রে - সব ক্ষেত্রেই হতে হবে।
কথা বলা শেখা
প্রথম কথা শেখা বা কথা বলা দিয়েই শুরু করা যাক। ভাইগোৎস্কি তাঁর জ্ঞান গঠনের তত্ত্বে বলছেন, শিশুর শেখাটা হয় একটা জানার উপর আরেকটা জানা। সেটা হয় নতুন জানা। অর্থাত একটা জানার উপর আরেকটা নতুন জানা। ঠিক ইঁট গাঁথার মতো। একটা ইঁটের উপর আরেকটা ইঁট গাঁথা। এই ভাবেই ইমারত তৈরি হয়। জ্ঞানের ইমারত। শিশু কথা বলা শেখে শুনে শুনে। শব্দভাণ্ডার তৈরি হয় শুনে। বাড়ির বড়োরা চিরাচরিত ভাবে তাকে একটা একটা শব্দ শেখাযন, যেমন বাবা, দাদা, মামা, নানা ইত্যাদি। তাহলে ভাষা শেখার ক্ষেত্রে যা দাঁড়ালো – তা হল, ভাষা শেখানোর প্রথম দায় বর্তায় পরিবারের উপর। শুরুতে শিশুরা বড়োদের মতো স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারে না। কারণ প্রথমত তার শব্দটা অজানা। দ্বিতীয়ত – জীভ ও ঠোঁটের উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তখনও আসেনি। তাই আমরা বড়োরা তার এই অপারগতা বা ইম’ম্যাচিউরিটি বুঝে শব্দ বা ভাষা শেখানোর সময় সহজ করে শেখাতে গিয়ে শব্দের বিকৃত উচ্চারণ শেখাই। ক্রমান্বয়ে সেটাই তার মাথায় থেকে যায়। যাকে বলে গোড়ায় গলদ। এক্ষেত্রে তাহলে দায় বর্তায় পরিবারের বড়োদের উপর!
তাহলে আমরা কী করতে পারি? আমরা শিশুদের ছোট ছোট শব্দ যা তার জীভ ও ঠোঁটের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার মধ্যে থাকবে সেটা বুঝে স্পষ্ট উচ্চারণটাই শেখাবো। শব্দকে বিকৃত করে নয়। প্রথম শেখাতে হবে একটা মাত্র শব্দ দিয়ে যেগুলো সহজে মুখে আসে। যেমন –আ, অ্যা, মা, না, পা, দা। তারপর আসতে পারে বাবা, দাদা, মামা, নানা, পাপা ইত্যাদি। অর্থাৎ একক শব্দ থেকে যমজ শব্দে আসা। এইভাবে বাক্য গঠন শেখাতে হবে। এটা হল শিশুকে পরিকল্পিতভাবে শেখানো। জ্ঞান গঠনের তত্ত্ব অনুসারে বলা হয়, একটা জানার উপর আরেকটা জানা। যেমন প্রথম জানতে হল মা, তার এই মা জানার উপর আরেকটা জানা যোগ হয়ে মামা হচ্ছে। ঠিক ইঁট গাঁথার মতো।
এইখানে প্রশ্ন হল – সব অভিভাবক কী এভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত? না, তা নয়। আর নয় বলেই শিশুরা ভালোভাবে ভাষা শেখে না। শেখার তারতম্য দেখা যায়।
শিশু অবস্থায় এভাবে শেখার পর যখন সে বড়ো হয়, তখন তার দায় বর্তায় শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর। আমাদের রাজ্যে বেশিরভাগ মানুষ বাংলাভাষী হলেও বিভিন্ন জেলায় ভাষার একটা আঞ্চলিকতা আছে। মান্য ভাষায় (স্ট্যান্ডার্ড ল্যাঙ্গুয়েজে) যদি বলি আসবো, তবে কোনো জেলায় তা বলা হয় আইসবো বা আসুম। আঞ্চলিকতার কারণেই এই অসুবিধা। এই ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা তার কাছে মাতৃভাষা হলেও যখন সেই শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবে তখন তাদের মান্য ভাষায় উচ্চারণ করতে এবং অর্থ বুঝতে অসুবিধা হবে। শিক্ষক এবং অভিভাবকদের এই দিক বিবেচনা করে দুটো ভাষার (মান্য ভাষা ও স্থানীয় বা মাতৃভাষা) মধ্যে সমন্বয়ে ঘটাতে হবে।
দ্বিতীয়ত – শিশুদের স্পষ্ট উচ্চারণ করতে শেখাতে হবে। কোন্ বর্ণে কোন্ শব্দে কোনখানে জোর দিতে হবে সেটা শুরু থেকেই শেখাতে হবে। যেমন ‘পর’ আর ‘পড়’ শব্দের উচ্চারণগত ফারাক আছে। ধৈর্য্য এই শব্দটা অনেক শিশু বলে ধৈয্য। বড়োরাও অনেকে এই ভুল করেন। এইসব পার্থক্য বোঝানো ও শেখানো দরকার ছোট থেকেই। এই রকম ভাবেই দেখা যায় ‘আসার’ (come) আর ‘আষাঢ়’ উচ্চারণের পার্থক্য থাকলেও আমরা শিশুদের শব্দ ও বর্ণের উচ্চারণ ঠিকমতো শেখাই না।
সুতরাং বর্ণ চেনা থেকে শুরু করে শব্দের উচ্চারণগত ফারাক শৈশব থেকে অত্যন্ত নিপুণভাবে না শেখালে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হল বানান ভুল। যেমন ‘তুমি পরে এসো’। আবার বলি ‘তুমি পড়ে এসো’। বর্ণের উচ্চারণে গোলমাল থাকলে শিশুরা এই ধরনের বাক্যের ক্ষেত্রে বানান ভুল করে ফেলে। এখানেই বর্ণ শেখানোর সময় ফোনেটিক লার্নিং (phonetic learnings) এর উপর শিশুকে ও অভিভাবককে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। শিশু কী শুনছে এবং কীভাবে তা উচ্চারণ করছে তা খুঁটিয়ে দেখা খুবই জরুরি। প্রয়োজনে সংশোধন করে দেওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মধ্যেই যদি এই উচ্চারণের সমস্যা থাকে তবে সে ক্ষেত্রে শিশুদের কি হবে!
এছাড়াও শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে এখনও বর্ণের বিকৃত উচ্চারণের অভ্যাস থেকে গেছে। ধ-কে সরাসরি ধ-না বলে কাঁধে পুঁটলি ‘ধ’ বলা। ‘র’-কে সরাসরি ‘র’-না বলে ‘ব’-শূন্য ‘র’ বলা, ‘দ’ কে হাটুভাঙ্গা ‘দ’ বলা ইত্যাদি। শিশুরা বর্ণকে নির্দিষ্ট নাম দিয়ে না শিখে যদি বিকৃত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেখে তবে তাদের বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। যেমন – যদি গাধা উচ্চারণ করাতে হয় তবে শিশু যদি বলে ‘গ’- এ আকার কাঁধে পুঁটলি ‘ধ’ এ আকার তবে প্রতিটি শব্দ, মাত্রা এবং বিকৃত বর্ণ উচ্চারণ মিলে সহজে গাধা শব্দটি মুখে উচ্চারিত হতে চাইবে না। অনেকগুলি ফোনেটিক মিলে একটা জগাখিচুড়ি মার্কা শব্দ তৈরি হতে চাইবে এবং তা আরো জটিল হয়ে শিশুর মাথায় পাক খেতে থাকবে, ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চারণে কষ্ট পাবে।
অথচ আমরা খুব সহজভাবে এগুলো শিখিয়ে দিতে পারি, শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতা। শিক্ষককে শিশু মনের স্তরে পৌঁছে তার সমস্যাটা বুঝতে হবে। এতে কিন্তু শিশুরা সহজে শিখবে, উচ্চারণ পরিষ্কার হবে, পড়তেও আনন্দ পাবে। নতুবা সমস্যা আরো গভীরতর হবে।
লেখা শেখা
এবার আসা যাক লেখা শেখানোর প্রশ্নে। লেখার ক্ষেত্রেও পড়ার মতো সহজ থেকে কঠিন এর দিকে যেতে হবে। একটা জানা জিনিসের উপর নতুন জানা যোগ করতে হবে। শিশুদের তিন বছর বয়স থেকে যেমন কিছু আঁকিবুকি করতে দিতে হবে। স্বাধীন ভাবে। এতে পেন্সিল ধরার উপর তার আধিপত্য কায়েম হবে। ধীরে ধীরে শিশুকে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু দাগ টানা, সোজা রেখা, বাঁকা রেখা, গোল করা ইত্যাদি করতে দিতে হবে। তার মনের মতো। কোন চাপ দেওয়া নয়। ক্রমান্বয়ে তার তৈরির আঁকিবুকির অংশ যোগ করলে কেমন ভাবে একটা বর্ণ তৈরি হয়ে যেতে পারে সেটা তাকে দেখাতে হবে। শিশু যখন টুকরো টুকরো রেখাকে যোগ করে হঠাৎ বর্ণ লিখে ফেলেছে দেখবে তখন সে লেখার আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। আরো লিখতে চাইবে সৃষ্টির আনন্দে। অনেকেই ছোট থেকে বর্ণ লিখে তার উপর দাগ বোলাতে দেন। শিশু যখন পেন্সিলই ঠিকমতো আয়ত্ব করতে শেখেনি, তখন একটা কঠিন বর্ণের উপর আঙুল ঘোরানো তার পক্ষে আরও কঠিন হয়। সেক্ষেত্রে আঁকিবুকি দিয়ে শুরু করে তারপর সেসব যোগ করে বর্ণ লেখা অনেক সহজ হয় এবং শিশুর কাছে তা আনন্দদায়ক হয়। দাগ বোলানো শিশুর কাছে কঠিন হয়। এটা অনুকরণীয় কাজ, সৃষ্টির আনন্দ নেই। নিজের আবিষ্কার থাকে না। স্বাধীনতাও থাকেনা।
ক্রমান্বয়ে শিশুদের বর্ণ লেখার সময় সঠিক আকৃতির বর্ণ লেখানো শেখাতে হবে। কোনরকম একটা বর্ণ লিখে দিলে তা পাঠ্য বইয়ের বর্ণের সঙ্গে তুলনা করে তাকে দেখাতে হবে তার বর্ণ লেখাটা কোনখানে ভুল হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় লেখার মূল্যায়নটাও হয়ে যায়। মাত্রা, যতি চিহ্নের ব্যবহার বুঝিয়ে ভালো করে শেখাতে হবে। কোন বর্ণে পূর্ণমাত্রা, কোন বর্ণে অর্ধমাত্রা, কোন বর্ণ মাত্রাহীন, তা শুরু থেকেই পাঠ্যবইয়ের সাহায্যে তাদের দেখাতে হবে এবং বোঝাতে হবে। শিশু একেবারেই ছাপার অক্ষরের মতো লিখতে পারবে না। তবে অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে সঠিকভাবে লেখার অভ্যাসে নিয়ে যেতে হবে।
বলা শেখা
এবার আসা যাক শিশুদের কথা বলার অভ্যাস বা দক্ষতা অর্জনের বিষয়ে। কথা বলার অভ্যাস শেখাতে গেলে প্রথম বোঝা দরকার যে, শিশুটি যে বিষয়টি বলতে চাইছে সে বিষয়ে তার স্পষ্ট ধারণা আছে কিনা। শিশু যদি সামনে একটা নদী দেখে তবে তাকে খুঁটিয়ে নদী দেখাতে হবে বা নদীর গল্প শোনাতে হবে যাতে সেখান থেকে তার স্পষ্ট ধারণা তৈরি হতে পারে। তখন আপনা থেকে সে তার ধারণা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে। কিন্তু ঘটনা যদি হয় উল্টো অর্থাৎ ধারণায় যদি তার অস্পষ্টতা থাকে তবে বলতে গিয়ে তোতলাবে, কথা আঁটকে যাবে। এছাড়াও শিশুকে শেখানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই স্থান, কাল, পাত্র, ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেগুলো শেখাতে হবে। সম্বোধন কীভাবে করবে, জোরে কখন কথা বলবে, আস্তে কোথায় কথা বলতে হয়, কোথায় মান্য বাংলা বলবে আর কোথায় চলিত বাংলা বলবে বা স্থানীয় ভাষায় কথা বলবে এগুলি তাকে শেখাতে হবে।
এই প্রক্রিয়া পদ্ধতিগুলি ক্রমান্বয়ে শিশুকে শেখাতে থাকলে পড়া, লেখা এবং বলা প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারবে।
শেষ করি কবিগুরুর কথা দিয়েই, তিনি বলছে, “শুঁটির মধ্যে যে বীজ লালিত হইয়াছে ক্ষেতের মধ্যে সেই বীজের বর্ধিত হওয়া চাই”।
খেত হলো পরিবার, সমাজ, শিক্ষক সকলে মিলে আমরা। আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে শিশুদের দক্ষতা খুঁজতে যাওয়া ভুল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct