আপনজন ডেস্ক: তুরস্কে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। শুধু তুরস্ক নয়, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতেই সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের মধ্যে একজন তিনি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মুসলিমদের মাঝেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়। এর কারণ এক সময়ের খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা তুরস্ককে তিনি পাল্টে দিয়েছেন নিজ হাতে। কামাল আতাতুর্ক দেশটিতে সেক্যুলারিজমের নামে ইসলাম চর্চার ওপর চরম আঘাত হেনেছিলেন; কিন্তু এরদোগান মানুষকে দিয়েছেন ধর্ম পালনের অবাধ স্বাধীনতা। পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতেও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছেন উচ্চকণ্ঠে। জোরালো ভুমিকা রাখছেন সকল আন্তর্জাতিক ইস্যুতে।১৯৫৪ সালে ইস্তাম্বুলের কাশিমপাশায় জন্ম নেয়া এরদোগান ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বাস্তবমুখী মানসিকতার। বাবা ছিলেন তুর্কি কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন। পরিবারে স্বচ্ছলতা থাকলেও তরুণ এরদোগান নিজের খরচ চালানোর জন্য লেবুর শরবত ও তিলের রুটি বিক্রি করেন। মারমারা ইউনিভার্সিটিতে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ার সময় ইসলামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। যোগ দেন কমিউনিজম বিরোধী ন্যাশনাল টার্কিস স্টুডেন্ট ইউনিয়নে। ফুটবলও খেলতেন স্থানীয় একটি নামকরা ক্লাবে। ছাত্রজীবন শেষে যোগ দেন নাজিমউদ্দিন আরবাকানের ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব সংগঠনে। ১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দলটি বিলুপ্ত করা হলে আরবাকানের নতুন দল ওয়েলফেয়ার পার্টির সাথে যুক্ত হন। এই দল থেকেই ১৯৯৪ সালে নির্বাচিত হন ইস্তাম্বুলের মেয়র। বিশৃঙ্খল আর অনুন্নত ইস্তাম্বুলকে আমূল পাল্টে দেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যে ইউরোপের বড় শহরগুলোর সাথে পাল্লা দিতে শুরু করে ইস্তাম্বুল। হু হু করে বাড়তে থাকে এরদোগানের জনপ্রিয়তা। যা তাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে দেশের সর্বোচ্চ পদে।
২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্টে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয় আবারো ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুসলিম বিশ্বের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনরায় জাগিয়ে তোলেন তিনি। তুরস্কের অর্থনীতির স্বার্থে আরব দেশগুলোর সাথে ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছে ছিল। বর্তমান তুরস্কে দেশটির সেনাবাহিনী পুরোপুরি বেসামরিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রকাশ্যে আমেরিকার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা’ হিসেব টুইটারের মাধ্যমে উল্লেখ করেন এরদোগান। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। গাজাকে একটি ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। পর্যবেক্ষক মারওয়ান মুয়াশের মনে করেন, ইসরায়েলকে নিয়ে এরদোগানের এসব বক্তব্য ফিলিস্তিন এবং জর্ডানে তাঁর ভক্ত বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, এরদোগানকে দেখা হয় এমন এক ব্যক্তি হিসেবে যিনি ইসরায়েল এবং আমেরিকার সামনে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক এখন ভালো অবস্থানে নেই। এরদোগান এখন কর্তৃত্ববাদী পথ বেছে নিয়েছেন।
বিনয়ী সূচনা
তুরস্কের একজন বিশ্লেষক ফেহিম তাসতেকিন, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে পড়াশুনা করেন, মনে করেন ইসরায়েলের সাথে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের যে অচলাবস্থা সেটি বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও জটিল।
তিনি বলেন, বাণিজ্যিকভাবে তুরস্ক এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরব দেশের জনগণ এবং তুরস্কের রাস্তায় এরদোগান আবির্ভূত হয়েছেন এমন একজন নেতা হিসেবে যিনি ইসরায়েলের সমালোচনা করেন।
কোন পশ্চিমা নেতার মধ্যে তারা এ বিষয়টি লক্ষ্য করেন না। এরদোগানের উঠে আসার গল্প তুরস্কের বহু মানুষকে আন্দোলিত করে। একটি ধার্মিক পরিবারে জন্ম নেয়া এরদোগান তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ শাসক গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং তুরস্কের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন।
কিভাবে এত জনপ্রিয়তা অর্জন করলো
এরদোগানের জনপ্রিয়তা হঠাৎ করেই আসেনি। সুশাসন, সমৃদ্ধি আর স্বনির্ভরতার স্বাদ যখন পেতে শুরু করেছে তুর্কিরা- তখনই এরদোগানের প্রতি বেড়েছে তাদের আস্থা। দীর্ঘদিন পশ্চিমা দেশগুলোকে ধর্ণা দেয়ার নীতিতে চলেছে তুরস্ক। কিন্তু এই নীতি পাল্টে জাতিকে মাথা তুলে দাড়াতে শিখিয়েছেন তিনি। ইউরোপ-আমেরিকার চোখে চোখ রেখেও যে কথা বলা যায় সেটি বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন মানুষকে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রবল আপত্তির মুখেও গণভোটে জিতে সংবিধান পাল্টে গ্রহণ করেছেন নির্বাহী ক্ষমতা। অর্থনীতি, কূটনীতির মতো সামরিক শক্তিতেও অনেক এগিয়েছে তুরস্ক। ২০১৫ সালে তুর্কি আকাশ সীমায় প্রবেশ করার মাত্র ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস করা হয় রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান। যা অসীম সাহসিকাতরই এক নজির।
ধীরে ধীরে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন এরদোগান। নেতৃত্বহীন মুসলিম বিশ্বকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে ও সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাড়িয়েছে তুরস্ক। জেরুসালেম ইস্যুতে ওআইসির চেয়ারম্যান এরদোগান জরুরী সম্মেলন ডেকে পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণা করেছেন। মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে চালিয়েছেন ব্যাপক কূটনৈতিক তৎরতা। কাতার সঙ্কটেও মধ্যস্ততার উদ্যোগ নিয়েছেন। সব কিছু মিলিয়ে তুরস্ক ও নেতৃত্ব দুটো বিষয়কেই বিশ্বের সামনে রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন এরদোগান।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct