আপনজন ডেস্ক: বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই সপ্তাহে রাজ্য বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের জন্য একটি বিল উত্থাপন করতে প্রস্তুত। রাজ্য পরিচালিত আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের তরুণ চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের পর থেকে কলকাতায় সাম্প্রতিক স্মৃতিতে দেখা যায়নি, এমন প্রতিবাদের ঝড় ওঠার পর থেকেই তৃণমূল – সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা – সবাই ধর্ষকদের জন্য ফাঁসি দাবি করে এক সুরে কথা বলেছেন।
তৃণমূলের এই ভঙ্গি রাস্তায় ক্ষোভ উগরে দিলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা কোনও সমাধান নয়, এই ধরনের অপরাধ কমবে না।
আইনি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বিধি সেন্টার ফর লিগ্যাল পলিসির গবেষণা পরিচালক অর্ঘ্য সেনগুপ্ত সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, আমরা কী ধরনের সমাজ নির্মাণ করছি? যখন বিচারকরা জানেন যে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃত্যু, তখন তারা একটি অপরিবর্তনীয় ভুলের ভয়ে আরও দ্বিধাগ্রস্ত হবেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিলে সব ধর্ষণ মামলাকে খুনের সমতুল্য গণ্য করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ন্যূনতম শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশ এর আগে সমস্ত ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে বিল তৈরি করেছিল। কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় তা পাশ হলেও তারা রাষ্ট্রপতির সম্মতি পায়নি। একই পরিণতি এড়াতেই বাংলার বিলে যাবজ্জীবন মেয়াদের বিকল্প চালু করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমি স্পিকারকে বলব বিশেষ অধিবেশন ডাকতে এবং ১০ দিনের মধ্যে ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে আইন।’ গত বুধবার মমতা বলেন, আমরা বিলটি রাজ্যপালের কাছে পাঠাব। কিন্তু আমি জানি উনি (রাজ্যপাল) কিছু করবেন না। তবে তাকে স্বাক্ষর করতে হবে। না হলে রাজভবনের সামনে বসবেন মহিলারা। এবার তিনি তা বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারবেন না।
লিগ্যাল পলিসির গবেষণা পরিচালক অর্ঘ্য সেনগুপ্ত আইনটি কার্যকর হওয়ার জন্য গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সুচিন্তিত, পদ্ধতিগত সংস্কার দরকার, নতজানু প্রতিক্রিয়া নয়। প্রতিটি মামলার খুঁটিনাটি বিষয় বিবেচনা না করে আইন চাপিয়ে দিলে ন্যায়বিচারের গর্ভপাত হতে পারে। ব্রিটেনের ব়্যাম্পটন হাই সিকিউর হাসপাতালের ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. পঞ্চজন্য ঘটকও একমত। যিনি কারাগারে থাকা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা ডা. ঘটক বলেন, আইন প্রণয়নের এই তাড়াহুড়ো অপরাধ, বিশেষত মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখায়। মৃত্যুদণ্ড, প্রায়শই প্রতিরোধক হিসাবে বিবেচিত হয়, বারবার অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যৌন অপরাধ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং উন্নত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছে যে এটি মোকাবেলার জন্য পদ্ধতিগত, ক্লিনিকাল পদ্ধতি প্রয়োজন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলটির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এখনও জনসমক্ষে আসেনি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এবং হিউম্যান রাইটস ল নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা কলিন গনজালভেস বলেছেন, বিলটি পাস হলে তা সাংবিধানিকভাবে সন্দেহজনক হবে যা মূলত অসাংবিধানিক। এটি বিবেচনার জন্য কোনও অবকাশ রাখে না। তিনি বলেন,
সুপ্রিম কোর্টে আফজল গুরু ও ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের হয়ে সওয়াল করেন গনজালভেজ। ২০০১ সালের সংসদ হামলার জন্য গুরুকে ২০১৩ সালে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল এবং কলকাতায় এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যার জন্য ২০০৪ সালে চ্যাটার্জিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যুদণ্ড ন্যায়বিচার নয়। এটা বর্বরতার কাছে সমাজের আত্মসমর্পণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা হাইকোর্টের এক ফৌজদারি আইনজীবী বলেন, আইনগতভাবে, এই বিলটির জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হবে, তবে এটি পাস হলেও এটি খুব বেশি অর্থবহ হবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct