ফৈয়াজ আহমেদ, আপনজন: ধূমপানের ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই নেটিভ আমেরিকানরা ধূমপান করতো। সেই হিসেবে নেটিভ আমেরিকানদের ধূমপানের উদ্ভাবক বলা চলে। শুধু তাই নয়, ধূমপানের মতো খারাপ অভ্যাস যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ছিল। বেশ কিছু সংস্কৃতিতে এর ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। সেসব সংস্কৃতির ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আগে মনকে শুদ্ধ করতে মানুষজন ধূমপান করতেন।
সব সংস্কৃতির ধূমপানের পদ্ধতি যে একরকম ছিল, এমন চিন্তাভাবনা করে থাকলে আপনার ভাবনা ভুল। প্রতিটি সংস্কৃতির ধূমপানের পদ্ধতি ও ছিল আলাদা। নেটিভ আমেরিকানরা ধূমপান করতো তামাক পাতা দিয়ে, কারণ এই অঞ্চলে এটিই বেড়ে উঠেছে। ভারত বা আফ্রিকার মতো অঞ্চলের মানুষজন করতো গাঁজার ব্যবহার করতো। কারণ এর উৎপাদন ও উৎপত্তি এখানেই সবচেয়ে বেশি। সাধারণ মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্কৃতির ধর্মীয় যাজক বা নেতারাও ধূমপান করেছেন। তাদের এই বিষয়ে মতামত ছিল ধূমপানের মাধ্যমে মানুষ ঐশ্বরিক আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
ধূমপানের বিষয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বা অঞ্চল এগিয়ে থাকলেও, ইউরোপীয়রা এই বিষয়ে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ১৫ শতকের আগ পর্যন্ত কেউ জানতোই না ধূমপান কী। ইউরোপীয়রা প্রথম ধূমপান সম্পর্কে জানতে পারে আমেরিকা আবিষ্কার করা অভিযাত্রীরা ইউরোপে ফিরে আসলে। ইউরোপে ধূমপান নিয়ে আসা প্রথম ব্যক্তি হলেন ‘রদ্রিগো ডি জেরেজ’। তিনি আসলে বিখ্যাত এক্সপ্লোরার ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অনুসন্ধান ক্রূর অংশ ছিলেন, যা আমেরিকাকে কেন্দ্র করে।
১৪৯২ সালে আমেরিকার ভূমিতে তাদের নেটিভ আমেরিকানদের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তারা নেটিভ আমেরিকানদের সঙ্গে উপহার বিনিময় করে এটা বুঝাতে যে তারা তাদের কোনো ক্ষতি করার জন্য এখানে আসেনি। তারা শুধু নতুন দেশ আবিষ্কার করার উদ্দেশ্যে এসেছে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও তার অভিযাত্রীরা উপহার হিসেবে তাদের জামা-কাপড়, খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়েছিল। আর এর বিপরীতে নেটিভ আমেরিকান উপজাতিটি তাদের তামাক দিয়েছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও তার অভিযাত্রীদলের কেউই জানতো না যে এই ভেষজগুলো কীসের জন্য। যদিও নেটিভ আমেরিকানরা বুঝিয়ে বলেছিল যে এগুলো বিলাসবহুল জিনিস। কলম্বাসের জাহাজের অন্যান্য ক্রুদের মতো রদ্রিগো ডি জেরেজ ও মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন, তারা এই তামাক দিয়ে কী করেন।
আমেরিকা আবিষ্কারের কিছুদিন পর যখন কলম্বাসের অভিযাত্রী ইউরোপে ফিরে যাচ্ছিল। তখন জেরেজ নিজের সঙ্গে কিছু তামাক নিয়ে নেন এবং তার ইচ্ছে ছিল নেটিভ আমেরিকানরা যেভাবে ধূমপান করেন তিনিও সেভাবে ধূমপান করবেন। নেটিভ আমেরিকান সেই উপজাতির ধূমপান দেখে তিনি এটা বুঝেছিলেন যে তামাক দিয়ে ধূমপান করলে তা শরীর ও মনের মধ্যে একটি শান্ত এবং শিথিল প্রভাব ফেলে। স্পেনে ফিরে যাওয়া জাহাজে বসেই তিনি প্রথমবার ধূমপান করেন।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অভিযাত্রীদের জাহাজ স্পেনের সেভিলার আয়ামন্টে বন্দরে পৌঁছালে, জেরেজ জনসমক্ষে ধূমপান করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণ মানুষজন তার নাক ও মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হতে দেখে ভেবে বসেছিল শয়তান হয়তো মানুষের রূপে পুনর্জন্ম নিয়েছে। যেহেতু এটি ঘটেছিল স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সময় (১৪৭৮-১৮৩৪) তাই রদ্রিগো ডি জেরেজকে তদন্তের জন্য কর্তৃপক্ষের সামনে হাজির করা হয়েছিল। জেরেজ কর্তৃপক্ষকে দেখিয়েছিলেন যে আমেরিকা থেকে আনা তামাক গাছের কারণে ধোঁয়া তৈরি হয়েছিল।
প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও, সেই সময় যেহেতু স্পেন ক্যাথলিক সম্রাটদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, তারা জানত যে তাকে মুক্ত করতে দিলে সাম্রাজ্যের মাঝে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। আর তাই তাকে ১০ বছরের জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছিল, যাতে লোকেরা তাকে ভুলে যায় এবং মনে করে রাষ্ট্র সেই মানুষ রূপী শয়তানকে হত্যা করেছে (ধূমপানের সময় মানুষজন তাকে পৈশাচিক ও শয়তানের আত্মা বলে ধরে নিয়েছিল এবং তা পুরো রাজ্যে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল)। আর সেই সঙ্গে স্পেন সম্রাট কর্তৃক তামাক গাছকে অপবিত্র বলে নিষিদ্ধ করা হয়।
নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও তামাকের আক্রমণ থেকে ইউরোপকে কেউ বাঁচাতে পারেনি। ১৬ শতক থেকে ইউরোপের উপনিবেশবাদীরা আমেরিকায় বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। সেই সঙ্গে তারা তামাক ব্যবসা ও শুরু করে, আর মুহূর্তেই তা পুরো ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯ শতকের শেষ দিকে সিগারেট আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি ব্যয়বহুল পাইপ থেকে ধূমপান করাটাই ছিল বেশিরভাগ লোকেরা তামাক ধূমপান করার একমাত্র উপায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct