মহ. মোসাররাফ হোসেন, আপনজন: ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে লর্ড ক্লাইভের যুদ্ধের নামে প্রহসনের ফলে বাংলা তথা ভারতবর্ষের যে সূর্য ডুবে গিয়েছিল, সেই সূর্যের উদিত হতে সময় লেগেছিল প্রায় দু’শো বছর! নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতের মানুষ নিজেদের দেশকে স্বাধীন করতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ৫৪ বার! ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে হিন্দু মুসলিম ঐক্য ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে টলিয়ে দেয়! তবুও ভারত স্বাধীন হতে প্রায় আরও একশো বছর অপেক্ষা করতে হয়! এই ভারতকে স্বাধীন করতে গ্রাম গঞ্জ শহর নগরের আপামর ভারতবাসীর অবদান অনস্বীকার্য! স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে স্বাধীনতা সংগ্রামী মুসলিম পুরুষদের নামের তালিকা সহজে পাওয়া গেলেও মুসলিম বীরাঙ্গনাদের নামের তালিকা পাওয়া সহজ নয়! কারণ মুসলিম সমাজের পর্দা প্রথা ও পুরুষ শাসিত সমাজে মহিলাদের রাজনীতির ব্যাপক প্রচলন ছিল না! তাই স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম মহিলারা অংশগ্রহণ করেও অন্তরালেই থেকে গেছে! তবুও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম মহিলাদের অবদান আলাদা ভাবে আলোচনা দরকার। কেননা, যে জাতি নিজেদের কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য চর্চা ও চর্যা করে না ; সে জাতি বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হয়! তাছাড়া বর্তমানে ভারতবর্ষের একটি বিশেষ শ্রেণি, মুসলিমদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মুছে দিতে চায়! অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ইতিহাস চর্চা জরুরী! বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ৫০ জন মুসলিম মহিলার নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে; স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা কীরূপ তা দেখে নেওয়া যাক!
বেগম হযরত মহল :-
১৮২০ সালে ফৈজবাদের এক গরীব পরিবারে জন্ম হয় বেগম হযরত মহলের! তিনি ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলীর দ্বিতীয় পত্নী! ১৮৫৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি অযোধ্যার বেগম বীরাঙ্গনা হযরত মহল স্বদেশ ভূমিকে স্বাধীন করতে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ রানীর শর্ত মেনে চলতে অস্বীকার করেন বেগম হযরত মহল! এক সময় ভারতীয় সিপাহীরা বেগম হযরত মহলকে অভিভাবিকা করে যুদ্ধ ঘোষণা করে! যুদ্ধ পীড়িত শহরে গরিবের শেষ আশা ভরসা স্থল ছিল বেগম হযরত মহল! বীরাঙ্গনা হযরত মহল ১৮৭৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন!
বীর মাতা বি-আম্মা:-
মাওলানা শওকত আলী এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী অর্থাৎ আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মাতা আবেদা বানু বি-আম্মা নামে পরিচিত! ১৯১৭ সালে কলকাতায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেসনে সভানেত্রী ছিলেন অ্যানি বেসান্ত।এই অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা পাঠ করেন।বোরখা পরিহিতা বি-আম্মা তাঁর স্বেচ্ছা সেবিকা বাহিনী নিয়ে অধিবেশনে উপস্থিত হলে বন্দে মাতরাম, আল্লাহু আকবার, কংগ্রেস কি জয়, বি-আম্মা কি জয়, রবে সভাগৃহ মুখরিত হয়! বি আম্মার মতো পর্দানশীলা মহিলার ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে মুসলিম মহিলারা স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।তাঁকে নিয়ে কবিতা রচিত হয়...” আলিদের মাতা নহ শুধু তুমি, মাতা সারা হিন্দের /ভারতের সব ধর্মের নর নারী বৃন্দের! ”
দৌলত-উন-নিসা :-
স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বীরাঙ্গনা দৌলত-উন-নিসা অসহযোগ আন্দোলনের মহিলা সমিতির পক্ষে গ্রামে গ্রামে প্রচার কাজ চালান। সেই সঙ্গে চরকায় সুতা কাটার আহ্বান জানান। মেয়েদের লেখাপড়া চর্চার কেন্দ্রেও তিনি গড়ে তোলেন।এক সময় দৌলত উন নেশা ইংরেজদের হাতে বন্দি হন এবং বিচারে তার কারাদণ্ড হয়!
আজিজুন বাঈ :-
ঘোড়ার পিঠে চেপে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, শেষ পর্যন্ত তিনি ইংরেজদের হাতে বন্দি হন এবং বিচারে তার ফাঁসি হয়! আজিজুনের নেতৃত্বে একদল মহিলা সিপাহী পুরুষদের পোশাক পরে যুদ্ধ করতেন! তাঁরা অস্ত্র হাতে ঘোড়ায় চড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানাতেন! যুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় সেনাদের জল সরবরাহ থেকে শুরু করে সিপাহীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতেন!
নুরুন্নেসা :-
এই বিদূষী মহিলা ছিলেন টুপি সুলতানের বংশধর! গুপ্তচরবৃত্তি ও গেরিলারা ট্রেনিং প্রাপ্তা নুরুন্নেসা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন! কিন্তু তিনি জার্মানিতে ধরা পড়েন এবং তাকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।তিনি ইংরেজিসহ বহু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
জামিলা খাতুন :-
উত্তরপ্রদেশের মুজাফফর নগরে এক পাঠান মুসলিম পরিবারে ১৮৩৫ সালে তাঁর জন্ম! সংগ্রামী বীরাঙ্গনাদের অন্যতম জামিলা খাতুন মহিলা বাহিনীর গঠন করে ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।তিনি ইংরেজ সৈন্যদের খাবারের বিষ মাখিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যান এবং ১৮৫৭ সালেই তাঁর ফাঁসি হয়!
বদরুন্নেসা:-
পাঁচ সন্তানের মা এই স্বাধীনতা সংগ্রামী মহিলা বহুবার ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েছেন এবং জেল খেটেছেন! দেশকে স্বাধীন করতে ইংরেজদের হাতে বহুবার লাঞ্ছিত হয়েছেন!
আসগরী বেগম :-
১৮১১সালে মুজাফফর নগরে জন্মগ্রহণ করেন আসগরী বেগম। তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন।সক্রিয়ভাবে যেসব মহিলা স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরে তাদের মধ্যে অন্যতম আসগরী বেগম এক সময় ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে এবং ইংরেজরা ১৮৫৮ সালে তাঁকে অগ্নিদগ্ধ করে পুড়িয়ে মারে।
মাজেরা খাতুন :-
নিজস্ব নারী বাহিনী গঠন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মহিলা সিপাহীদের জন্য তিনি নিজস্ব ড্রেসকোড তৈরি করেন।ফলে সহজে বোঝা যেত না যে, সেই সব সিপাহী গুলি মহিলা না পুরুষ অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন এবং শাহাদাত বরণ করেন!
রাহিলা খাতুন :-
১৯১৩ সালের ১৭ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গার ঝুনকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন! ১৯৩৭ সালে নারী সদস্যা হিসেবে অনুশীলন সমিতির সেবা বিভাগে যোগদান করেন! গোপনে খবর দেওয়া, ওষুধ সংগ্রহ, খাদ্য পরিবেশন, বিপ্লবীদের আত্মরক্ষার পথ নির্দেশ ইত্যাদি কাজ তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন।
হোসেনে আরা বেগম :-
১৯১৬ সালের ৮ ই জুলাই উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।মাওলানা মুহাম্মদ এবাদতউল্লাহর কন্যা এবং ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভ্রাতুষ্পুত্রী বীরাঙ্গনা হোসেনে আরা বেগম ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন।মেয়েদেরকে শিক্ষা দীক্ষা, দেশ সেবা, চরকায় সুতো কাটা, সেলাই কাজ করা এবং সবদিক থেকে স্বনির্ভর হয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন! তিনি মহিলা সমিতির মিছিল পরিচালনা করতেন।আন্দোলন অবস্থায় কলকাতা মুভমেন্ট হলের কাছে তিনি ধরা পরেন এবং তার কারাবাস হয়।আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে তাকে বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়! তার নেতৃত্বে মিছিলে বন্দেমাতরম, আল্লাহু আকবার ধ্বনি মুখরিত হয়।ছয় মাস পর জেল থেকে তিনি মুক্তি পেলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে অভিবাদন জানান। সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমদ ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁকে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে বলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কারাবরণ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৪৯ সালে অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায় চলে যান এবং সেখানেই ১৯৯৮ সালের ৩০ শে মার্চ পরলোক গমন করেন।
এছাড়াও সাওলাতুন নেসা, অ্যাডভোকেট বেগম সাকিনা মোয়াজ্জেদা, অরুনা আসাফ আলী, জোহুরা খাতুন, সুফিয়া খাতুন, লায়লা সামাদ, আবিদা বিবি, জোহরা বিবি, আদালা সুলতানা, জদ্দন বাঈ, হাজেরা বেগম, বন বিবি, হাবিবা খাতুন, রাজিয়া খাতুন, হালিমা খাতুন, বেগম আলী সাহেবা, আমজাদি বেগম, সৈয়দা মোতাহেরা বানু, কুলসুম সাইয়ানি, বেগম নিসাতুন নেসা মোহানি, জামালুন্নেসা, সায়েদা খাতুন, জোবেদা খাতুন চৌধুরী, হাজেরা বিবি ইসমাইল, বেগম আনিস কিদোয়াই, বেগম মেহবুব ফাতিমা, সায়েদ ফখরুল হাজিয়া হাসান, বেগম আজিজা ফাতিমা ইমাম, উমেদা বাঈ, জুবাইদা দাউদি, সাদাফ বানু কিচলি, জুলেখা বেগম, নিসাতুন্নেসা বেগম প্রমুখ।
কিন্তু, হায় যাঁদের আন্দোলনে আমরা আজ স্বাধীন মানচিত্র পেয়েছি, তাঁরাকে কতটুকু মনে রেখেছি! চর্চা করেছি, তাদেঁর শুভ কাজে কতটুকু অনুপ্রাণিত হয়েছি! নিজেকে আজ প্রশ্ন করার সময় এসেছে, নিজেরই প্রয়োজনে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে।
(লেখক প্রাবন্ধিক ও সহকারী শিক্ষক,আই সি আর হাই মাদ্রাসা উ.মা.)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct