এই বাংলায় পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, ধূপগুড়ি, কাকদ্বীপ, মধ্যমগ্রাম, সুনিয়া, হাঁসখালি প্রমুখের ধর্ষণ কান্ডে দোষীরা আজও সাজা পান নি। অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে দিনের আলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটার পর একটা ধর্ষণ কান্ডে দোষীদের সাজা না হওয়াতে এ রাজ্যের দুর্বৃত্তদের ধর্ষণে সাহস জুগিয়েছে বললে হয়তো খুব একটা ভুল বলা হবে না। লিখেছেন সনাতন পাল...
এই বাংলায় পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, ধূপগুড়ি, কাকদ্বীপ, মধ্যমগ্রাম, সুনিয়া, হাঁসখালি প্রমুখের ধর্ষণ কান্ডে দোষীরা আজও সাজা পাননি। অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে দিনের আলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটার পর একটা ধর্ষণ কান্ডে দোষীদের সাজা না হওয়াতে এ রাজ্যের দুর্বৃত্তদের ধর্ষণে সাহস জুগিয়েছে বললে হয়তো খুব একটা ভুল বলা হবে না।
বিগত দিনে ধর্ষণ কান্ডে সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে মিডিয়ার সামনে যে ভাবে সাজানো ঘটনা, ছোট ঘটনার তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছে, তাতে ধর্ষকরা যে উৎসাহিত হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্ষকদের কঠোরতম শাস্তির বন্দোবস্ত করার দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ না করে ধর্ষিতাকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শাসক পক্ষের কেউ একথা বলতেই পারেন,”সরকার কি তাহলে ধর্ষণ করতে বলেছে নাকি?”অবশ্যই তা নয়। কোনো সরকারই সেটা বলে না। কিন্তু ঘটনা ঘটার পরে দোষীদের অপরাধ করার সপক্ষে তথ্য এবং প্রমাণ সহ আইনের দরজায় হাজির করার ব্যবস্থা পুলিশ প্রশাসনকেই করতে হয় এবং সরকারি উকিলকেই দোষীদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভাবে আদালতে সাওয়াল জবাব করতে হবে। কিন্তু আমরা অধিকাংশ মামলাতেই দেখি সরকারি উকিলের যুক্তি আদালতে টেকে না। মোটামোটি এর চারটে কারণ হতে পারে - হয় পুলিশ দোষীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ জোগাড় করতে পারেন না- না হয় সরকারি উকিল কোনো অজ্ঞাত কারণে নিজে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। নইলে তদন্তের নাম করে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার পরিবর্তে লোপাট করার বন্দোবস্ত করা হয়। অথবা সরকারি উকিল এবং তদন্তকারীদের মেধার অভাব। সঠিক কারণটা সরকার বলতে পারবে।
ধর্ষণের বিভিন্ন কেস হিস্ট্রি পর্যালোচনা করলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কেস ডায়রিতে যে সকল আসামীর নাম থাকে- চার্জ সটে কখনও কখনও কোনো কোনো আসামীর নাম বাদ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসে পুলিশ তাহলে প্রথমে কেস ডায়রিতে যাদের নাম রেখেছিল সেখানে নির্দোষের নাম ঢুকলো কেন? নাকি কাউকে রাজনৈতিক অভিসন্ধি? যেমন কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে অন্যায় ভাবে আইনের জালে ফাঁসানো অপরাধ, তেমনি দোষীদের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য প্রমাণ হাজির না করাটাও পুলিশ প্রশাসনের বিশাল ব্যর্থতা। এ যাবৎ কাল পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারি উকিল দের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ শোনা গেছে, তা কতখানি সত্য আর কতখানি মিথ্যা, আশা করি ভূক্তভুগীদের অভিজ্ঞতায় সেটা রয়েছে। তবে অনেকেই বলেন এই নাম যুক্ত হওয়া এবং বাদ পড়া অনেক সময় নাকি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে ঘটে থাকে। সরকার কে কঠোর ভাবে দেখতে হবে এই সমস্ত মামলাতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কোনো প্রভাব স্পর্শ করতে যাতে না পারে। এই রাজ ধর্ম কোন যদি কোনো সরকার পালন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই সরকার থাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নৈতিক প্রশ্ন উঠবেই।
তপন দত্ত, বরুণ বিশ্বাস, সাইফুদ্দিন মোল্লা, সাগর ঘোষ, সুদীপ্ত গুপ্ত, কাজী নাসিরুদ্দিন শেখ, রিয়াজুল মোল্লা, সুশান্ত হালদার, আশমিরা বেগম, কৌশিক পুরকাইত, নরোত্তম মণ্ডল, মইদুল ইসলাম মিদ্যা, তাপস চৌধুরী, সৌরভ চৌধুরী, মফিজুল ইসলাম, আলমগীর মোল্লা, আনিস খান প্রমুখ খুনে ন্যায় বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি- কারও সাজা হয়নি। অনেকের অভিযোগ এতদিন নাকি শাসকের চোখ রাঙানিতে সব ধামাচাপা পড়েছে।
তাই আর.জি করের ঘটনায় তিলোত্তমার খুন কে আত্মহত্যার নাম করে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই চিকিৎসক সমাজ সহ সারা রাজ্যের মানুষ রণহুঙ্কার দিয়ে পথে নেমেছেন। প্রথম থেকেই ঘটনা প্রবাহ দেখে সাধারণ মানুষের মনে হয়েছে একদিকে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন- অপরাধীর ফাঁসি চাই, অপর দিকে সমস্ত তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে সন্দীপ ঘোষ সহ কলকাতা পুলিশের কর্তারা কেউ কেউ এক যোগে কাজ করছেন বলে অভিযোগ। সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে যখন সত্য গোপনকরার অভিযোগ উঠছে, তখন তাকে লাল বাজার জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করে নি। বরং উল্টে তারা যেকে পাঠাচ্ছেন প্রতিবাদীদের।
কেন রাতারাতি হাসপাতাল ক্রাইম স্পটকে ভেঙে তড়িঘড়ি করে রিপিয়ারিং করা হল? রাজ্যে বিগত দিনে কোনো উন্নয়ন মূলক কাজ এমন দ্রুত গতিতে হয়নি। তাহলে আর. জি করে এই রকম একটা খুনের ঘটনা ঘটার পরেও কেন রিপিয়ারিং এর কাজ এত দ্রুত করা হল? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে প্রমাণ লোপাটের জন্যই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই অতি সক্রিয়তা? আবার লাশকে দাহ করতেই বা পুলিশ এতো সক্রিয় কেন তা িনয়েও প্রশ্ন থেকে গেছে? অপর দিকে আইনে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সূর্যাস্তের পরে ময়না তদন্ত করা হল কেন তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সন্দীপ ঘোষ এবং কলকাতা পুলিশের সিপি কে খোলসা করে বলা উচিত। কিন্তু মামলা সিবিআইকে দেবার পরেও তা নিয়ে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে এই মামলায় প্রকৃত আরও কারা জড়িদ তা নিয়ে এখনও কোনও ইঙ্গিত মিলছে না। কিন্তু বাংলার মানুষ এবারটা কোনো যদি, কিন্তু, হয়তো, নতুবা, এসব শুনতেই চাইছেন না। তাই তো এই বার আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় সারা রাজ্যের মানুষ পথে নেমেছেন। প্রতিবাদে-ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। বাংলা সহ সারাদেশ উত্তাল। এমন কি প্রতিবাদের ঢেউ বিদেশের মাটিতেও আছড়ে পড়েছে। সবাই বলছেন, “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”। কিন্তু এখনও পর্যন্ত জাস্টিস পাওয়ার ধারে কাছে গিয়েছে বলে ঘটনা প্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে না। বাংলার মানুষ বিগত দিনের মত, “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”বলে নিজেদের সান্ত্বনা দিতে একদম রাজি নন। সবাই বিচার চাইছেন। সকলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রার্থণা করে বলছেন “এবার টা যাতে তারিখ পে তারিখ না হয়। প্রকৃত দোষী যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়”। বাবরি মসজিদ মামলার রায় দানকারী বিচারপতির পরে সাংসদ হবার দিন থেকেই আদালতের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ভিত কিছুটা হলেও দূর্বল হয়েছে। এই দুর্বলতা কাটাতে পারে একমাত্র আদালতই।
আন্দোলনের তীব্রতা আরও বেড়েছে কারণ অনেকের ছেলে মেয়েরা বাইরে পড়ে। আবার ঘটনাটি ঘটেছে কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক তরুণীর সাথে। অপর দিকে ঘটনার নৃশংসতা মানুষের বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়েছে। দেশবাসী মৃতাকে নিজেদের সন্তানের জায়গায় রেখে অনেকেই আন্তরিক ভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ এমন থাকতেই পারেন, যিনি হয়তো ভেবেছেন আন্দোলনে নামাটা নাগরিক হিসাবে তাঁর নৈতিক দায়িত্ব। তবে কেউ নিজেকে সফেদ প্রমাণ করতে বা প্রতিবাদী সাজাতে আন্দোলনে নেমেছেন বলে মনে করা উচিত নয়। কারণ প্রতিবাদী হওয়া অনেক কঠিন কাজ এবং এই জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংঘর্ষ করতে হয়। তাই এই সস্তা মানসিকতা নিয়ে কেউ আন্দোলনে নেমেছেন বলে মনে হয় না। তবে সোস্যাল মিডিয়া মানুষকে দ্রুত সংগঠিত করেছে।
দুই সপ্তাহ হয়ে গেল এখনও প্রকৃতি দোষী ধরা পড়ল না। তদন্তকারী সংস্থার দায়িত্ব ভার বদল হয়েছে। কোর্ট বদল হয়েছে। সবাই সুপ্রিম কোর্টের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। দেশের মানুষ নজর রাখছেন- সি বি আই কি করে! বিগত দিনের মামলা গুলির মত ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কি না। আন্দোলনের ঝাঁঝ দেখে মনে হচ্ছে কোনো সেটিং এবং সুবিচার না পাবার কথা রাজ্য তথা দেশবাসী শুনবেন না। ন্যায় বিচার না পেলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে।
বর্তমানে সন্দীপ ঘোষের কার্যক্রম এবং তার প্রতি রাজ্য সরকারের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ একে অপরের যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন। মানুষকে নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এই বিতর্কের নিরসন করতে পারেন সরকারের প্রধান নিজেই। প্রশ্ন যখন এসেছে, তখন সৎ সাহস থাকলে তাঁরই মিডিয়ার সামনে বলে দেওয়া উচিত যে, সন্দীপ ঘোষের উপরে রাজ্য সরকারের এত দুর্বলতা কেন? আর সন্দীপ ঘোষই বা এটা কেন আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন, তা নিয়েই প্রশ্ন থেকে গেছে। তবে রাজ্যের তরফে কপিল সিব্বাল সহ অতোগুলি আইনজীবীকে রাজ্য সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে দাঁড় করানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন দোষীর ফাঁসি হোক। তাই তা নিশ্চিত করতে এমন জাঁদরেল আইনজীবীদের দাঁড় করানোয়প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সরকার যখন চাইছে ফাঁসী হোক তাহলেও কি বিপুল অর্থ নিয়ে এমন আইনজীবীদের দাঁড় করানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। তবে, এটাও হতে পারে, ফাঁসির দাবিকে জোরদার করতে বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী হয়ত হালকা চালে নিতে চাইছেন না। অনেকে প্রশ্ন তুলছে সরকার বদল বা মুখ্যমন্ত্রী বদলের। তা হলেই কি সমস্যা আশু সমাধান হবে? হয়তো খানিকটা কার্যক্রমের বদল ঘটবে, মানুষ কিছুটা সস্তিও পেতে পারেন। কিন্তু সমস্যার বীজ সমাজের মধ্যে থেকেই যাবে। যেখান থেকে আবার এ ধরণের অপরাধের চারা গাছ জন্মাবে। তাই সমাজকে গোড়া থেকে এসব ধরণের অপরাধ মুক্ত করতে পারিবারিক শিক্ষা যেমন ভীষণ জরুরি, তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক ক্ষেত্র গুলিতে ন্যায় শিক্ষা এবং নীতি শিক্ষার চর্চা থাকা জরুরি। এই শিক্ষা শুধু পুঁথিগত নয়। এমন ভাবে সমস্ত ব্যবস্থাপনা তৈরি করা দরকার যাতে করে শৈশব থেকেই সকলের ভেতরে সত্য, ন্যায়, নীতি, আদর্শের পথ ধরে চলার জন্য আপনা আপনিই মানসিক স্থিতি তৈরি হয়। যদি ছিদ্র থাকে এবং সেই ছিদ্র দিয়ে কোনো অপরাধ ঘটলে সরকারকে দ্রুত কড়া হাতে দমন করতে হবে এবং অপরাধী যেন শাস্তি পায় সরকারের প্রতিটা স্তর কে সে বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে।
আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় সারা বাংলায় যে আওয়াজ উঠেছে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”, “সবার একটাই স্বর আর.জি. কর”। এই আওয়াজের মধ্যে শুধু আর.জি. কর নেই- লুকিয়ে আছে সেই দাবী, আগামী দিনে নারী সুরক্ষাকে নিশ্চিত করতেই হবে। নইলে নারী শক্তি রাজার চেয়ারের পা ধরে এমন ভাবে মারবে টান- রাজা হবে খান খান।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct