তন্ময় সিংহ, আপনজন: আবার এক স্বাধীনতা দিবসের নতুন ভোরে দাঁড়িয়ে দেশবাসী প্রত্যেক বারের মতো সেই আলোর জন্য অন্তহীন অপেক্ষায়। লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে প্রত্যেক বছরই যে শুরু হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ গনতন্ত্রের বার্ষিক উদযাপন । এবছর যদিও স্বাধীনতার উদযাপন লালকেল্লায় শুরু হওয়ার আগে থেকেই, পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু হয়ে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহিলাদের মাঝরাতে একত্রিত হয়ে তাদের ভয়হীন জীবন যাপনের অধিকারের দাবিতে সরব উপস্থিতি অন্য মাত্রা নিয়েছে। নারী কে দেবী হিসেবে পূজা করে আসা এই ভারতে,গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রান্তে মহিলারা লাঞ্ছিত হয়েছে , সমাজের বিকৃত মনস্ক পুরুষেরা সেই লাঞ্ছনার জন্য দায়ী হলেও, অনেক সময় প্রভাবশালী তত্ত্ব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আমাদের লজ্জিত করেছে, স্বাধীনতা খর্ব করেছে। আবার বিশ্বের সর্ববৃহৎ যুবসমাজের দেশের বেশিরভাগ অংশের নীরব থাকা ও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা আমাদের সমাজের অন্ধকারকে আরো ঘনীভূত করেছে। মনিপুর থেকে শুরু হওয়া যে অন্ধকার গো বলয় উত্তর প্রদেশের হাথরস দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আরজিকর হাসপাতালে চলমান, তা স্বাধীনতার এত বছর পরে লজ্জিত করে আমাদের, এ এক চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়, সমাজের নিকষ অন্ধকার।
২০১৯ এর পর থেকে আমরা প্রায় বর্তমান কাল নিয়ে ভাবতে সময় পায়নি, দেখানো হয়েছিল ২০৪৭ সালের রঙিন ভারতের স্বপ্ন। সেই প্রত্যাশার ফানুষ, কখন যেন গোঁত্তা খেয়ে ফিরে এসেছে ২০২৪ এর রুক্ষ বাস্তবে। এ ভারত কোনরকমে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দিন কাটানো অসম্ভব অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে চলতে থাকা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। যেখানে মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে আছে সারা ভারতের আশি শতাংশ ধন সম্পদ। এ ভারতে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভগুলো সারা বিশ্বের নিরিখে যেভাবে পিছনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা অনেকটাই আমাদের দরিদ্র মানুষের আরো দরিদ্র হওয়ার সাথেই তুলনীয়। এ ভারতে আজও জাতিভিত্তিক ধর্মভিত্তিক বিভেদ আছে, পিছিয়ে পড়া আছে, আছে সামাজিক আরো বিভিন্ন ব্যাধি সহ নারীর উপর অত্যাচারের ঘটনা। স্বাধীনতা এবং তার পরবর্তীতে ১৯৪৭ এর দেশভাগ এবং দাঙ্গা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাব। মেয়েদের লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল সবচেয়ে বেশি, ইজ্জত রাখতে নারী কেই দিতে হয়েছিল সবচেয়ে বেশি বলিদান।
সেই বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ এছাড়াও সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলে সার্বিকভাবে ১৫ ই আগস্ট এলেই তাদের মনে পড়ে যায় বিভাজনের কালো দিনগুলি। ২০২৪ এর আগস্টে দুই বাংলাতেই ঘটে গেছে বা চলমান এক সমাজ বিপ্লব। পড়শী দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভ শক্ত হাতে সরকার দমন করতে গিয়ে রক্তাক্ত করছেন তিন শতাধিক। তারপরেও বিদ্রোহ থেমে থাকেনি, শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন দেশ ছাড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন কার্যকরী সরকার গঠিত হয়েছে নোবেল জয়ী অর্থনীতির বিশেষজ্ঞকে মাথায় রেখে ছাত্রদের প্রতিনিধি নিয়ে। এরই মাঝে অরাজকতার সুযোগে সংখ্যালঘু হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে। তবে, অপরদিকে হিন্দুদের রক্ষা করতে মুসলিমরাও পাশে দাঁিড়য়েছেন সেই দৃশ্য সামনে এসেছে। লড়াইয়ের মাস আগস্ট, বাংলা ও বাঙালির রক্তাক্ত হওয়ার বারবার ঘটে আগস্টে ই।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে, সমাজের যে বন্ধু হতে পারত, সেরকম একজন আগামীর হবু ডাক্তারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ধর্ষণের পর শহর কলকাতার বুকে অন্যতম সেরা হাসপাতাল আরজিকরে। বিভিন্ন মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী আমরা দেখতে পেলাম অন্ধকার সমাজের প্রশাসনিক স্তরে এখনো গাঢ়, তার সাথে চলমান অসংবেদনশীলতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশ্যে। শহরের অন্যতম ব্যস্ত হাসপাতালে ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রায় সাত থেকে আট ঘণ্টা পর বুঝতে পারা যায় এতোবড় একটা নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। সহকর্মী থেকে শুরু করে নিরাপত্তা কর্মী সকলের উদাসীনতার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সার্বিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফেও। প্রথমেই আত্মহত্যা বলে বাড়িতে খবর দেওয়া হয়, তারপর বাবা-মাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে মৃত মেয়েকে দেখতে দেওয়া এবং যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিবারের প্রতি সংবেদনশীল না হয়ে ও নিজেদের গাফিলতি কে গুরুত্ব না দিয়ে মৃতার ডিউটি রত অবস্থায় অন্য স্থানে থাকার কারণ জানতে চাওয়া বা ভাসিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন তত্ত্ব, প্রতিষ্ঠানের দোষ ঢাকতে। তারপরেও চলে আসা নিয়ম মেনেই দোষারোপের পালা, ষড়যন্ত্রের তথ্য, আড়াল করার প্রচেষ্টা, সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন থিওরি ও এই সুযোগে মৃতা ও নৃশংস ঘটনায় বিভিন্ন জনকে অভিযুক্ত করে তথ্য প্রমাণ ছাড়াই চরিত্র হননের চেষ্টা। এরই মাঝে কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করে প্রবাসী বিহারী এবং বকলমে হাসপাতালে প্রশাসনের সমস্ত জায়গায় যাওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার কে। ঘটনার অভিঘাত ও পারিপার্শ্বিক বিবরণ একাধিক খুনীর উপস্থিত থাকার সম্ভাবনার কথা জানান দেয় । কাউকে আড়াল না করে, ন্যায় বিচারের দাবি ওঠে সর্বত্র। একাধিক খুনি থাকতে পারে বলে মতামত দেন মুখ্যমন্ত্রীও, তিনি পরিবারের পাশে যান ও ন্যায় বিচারের আশ্বাস দেওয়ার পর গঠন করেন “সিট”। এরই মাঝে ন্যায় বিচার চেয়ে কোর্টে লড়াই, মৃতার বাবা মায়েরও ন্যায় বিচারের জন্য কোর্টে যাওয়া এবং আগে বহু ব্যার্থতার থাকার পরেও সিবিআইয়ের হাতেই কোর্টের ভরসা ও আপামর জনসাধারণের ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা।
এরই মাঝে জনজাগরণ। যা ছিল প্রথম দিকে ইন্টার্নদের নিজস্ব আন্দোলন, সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ওপিডি ও চিকিৎসা বিভাগ প্রায় অচল করে আগামী দিনের চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। সিনিয়র ডাক্তার দিয়ে সারা রাজ্য জুড়ে জরুরী পরিষেবা কোন রকমে চলমান রেখে হবু ডাক্তারেরা রাজপথে সহকর্মীর জন্য সঙ্গত ন্যায় ও কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা চেয়ে । ঘোলা জলে মাছ ধরতে আসা কিছু সমাজের বিজ্ঞরা বুঝতে ভুল করেছিল, পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ বাংলাদেশের ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিবাদ দেখে বর্তমানে সক্রিয়। তাই কোন পঙ্কিলতায় আটকে না থেকে, তথাকথিত কোন রাজনৈতিক দলের ভরসায় না থেকে তথাকথিত কোনো সমাজসেবী অথবা বুদ্ধিজীবী মহলের ভরসায় না থেকে, মৃতা সহ নাগরিকের জন্য হবু ডাক্তারদের এই আন্দোলনের জন্য সহমর্মিতা শহর কলকাতার সর্বত্র । রাজধানীতে আটকে না থেকে, ন্যায় বিচার চেয়ে ও রাতের নিরাপত্তা চেয়ে এই জনজাগরণ ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া আগামীর ডাক্তার “তিলোত্তমা” হয়তো তার জীবন দিয়েই উৎসারিত করছে নতুন এক আলো। অন্ধকার কেটে গিয়ে আগামীর বার্তা নিয়ে আসবে যে আলো। নতুন করে মানুষের উপর ভরসা করার, সমাজের উপর ভরসা করার, সমাজের সমস্ত প্রতিষ্ঠান গুলির উপর বিশ্বাস করার ভরসা জোগাবে এই আলো। দূর করবে সমাজের সর্বত্র জমে থাকা অন্ধকার, নিরাপদে রাতের দখল নেবে মেয়েরা। মাতৃশক্তির আরাধনায় বিশ্বকে মাতিয়ে রাখা বাঙালি অবাক হয়ে বিশ্বকে দেখাবে , মাতৃশক্তির নব অকালবোধন। দিকে দিকে ধ্বনিত হবে :
“অসতো মা সদগমায়া,
তমসো মা জ্যোতির্গময়”
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct