সুভাষ চন্দ্র দাশ, ক্যানিং, আপনজন: সরকারি অবহেলায় ধ্বংস হয়ে ঐতিহ্য নষ্ট হতে বসেছিল ক্যানিং শহরে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ক্যানিং শহরের শেষ ঐতিহ্য লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ি।সংস্কারের অভাবে বাড়িটি ভেঙে পড়ছিল। যদিও ২০১৮ সালে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি কে ঐতিহ্যশালী ভবনের স্বীকৃতি দেয়।বর্তমানে স্মৃতিটি রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে।যাতে করে সংরক্ষণ এবং স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা যায় তারজন্য তৎপর হয়েছিলেন ক্যানিংয়ের বিধায়ক পরেশরাম দাস।বিগত দিনে একাধিকবার জেলা শাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি দিয়েছিলেন।অবশেষে ভবনটি সংস্কার করে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিল প্রশাসন।সোমবার প্রশাসনের কর্মকর্তা ক্যানিং এর মহকুমা শাসক প্রতীক সিং সহ সরজমিনে খতিয়ে দেখেন পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন।উপস্থিত ছিলেন ক্যানিং পশ্চিমের বিধায়ক পরেশরাম দাস সহ অন্যান্যরা।
বিধায়ক জানিয়েছেন, ‘লর্ড ক্যানিয়ের বাড়িটি কিভাবে সংরক্ষতি করা যায় তার জন্য সরজমিনে খতিয়ে দেখা হয়েছে। এছাড়াও ক্যানিংয়ে একটি অডিটোরিয়াম হল তৈরীর জন্য জেলা শাসক কে চিঠি দিয়েছিলাম। সেটার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে তা নির্মাণ কাজ শুরু হবে।’
উল্লেখ্য ১৭১ বছর আগে সুন্দরবনের খুব কাছেই মাতলা নদীর তীরে অবস্থিত এই বিলাশবহুল বাড়িটি তে দিন কাটিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ দম্পতি।ভদ্র মহিলা ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত এক চিত্রশিল্পী।তাঁরই শিল্পকলার যাদু আজও শোভা পায় সুদূর ইংল্যান্ড সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন যাদুঘরে।তৎকালীন সময় প্রত্যন্ত এই সুন্দরবন থেকে সুন্দরবনের নদীনালা,প্রাকৃতিক বৈচিত্র সহ গ্রাম বাংলার ছবি এঁকে তাঁর এক বিখ্যাত বান্ধবী কে চিঠি পাঠাতেন।আর সেই বান্ধবী হলেন খোদ রাণি ভিক্টোরিয়া।বিখ্যাত সেই চিত্রশিল্পী ভদ্র মহিলার শ্বশুর ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর স্বামী ছিলেন চার্লস ক্যানিং (লর্ড ক্যানিং)।চিত্রশিল্পী ভদ্রমহিলা হলেন শার্লোটের।
তৎকালীন সময়ের তাঁর সেই সাধের ঐতিহ্যবাহী বিলাশবহুল বাড়ীটি সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্তীর পথে!পাশাপাশি সুন্দরবনের বুক থেকে চিরতরে শেষ হতে চলেছে বিট্রিশ ইতিহাসের শেষ স্মৃতির অধ্যায়টিও।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় অশান্ত উত্তেজিত ভারতবর্ষ কে শান্ত করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল ও প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং।বিদ্রোহীদের যেমন কড়া হাতে দমন করেছিলেন। তেমনই আবার ভালোবাসাও দিয়েছিলেন।এমন কর্মকান্ডের জন্য তাঁর নাম হয় “ক্লেমেন্সি ক্যানিং”।
উল্লেখ্য এর বেশ কয়েক বছর আগেই ১৮৫৩ সালে সুন্দরবনের দাপুটে নদী বিদ্যাধরী আর মাতলা নদীর সংযোগস্থলে বন্দর গড়ার কথাও চিন্তাভাবনা করেছিলেন।সেই সময় লর্ড ক্যানিং মাতলা ৫৪ নম্বর লটের ২৭ হাজার বিঘা জমি কিনেছিলেন মাত্র ১১ হাজার টাকায়।তাঁরই উদ্যোগে সাধের বিলাশবহুল বাড়ীটি তে তৈরি হয় পোর্ট অফিস।জরিপের জন্য বিলেত থেকে আনা হয় নামিদামি যন্ত্রপাতি এবং বইপত্র।কোন কাজ সেভাবে এগোয়নি।১৮৬১ সালে মারা যান লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রী শার্লোটের(লেডি ক্যানিং)। শোকস্তব্ধ লর্ড ক্যানিং ফিরে যান ইংল্যান্ডে।১৮৬২ সালে তিনিও পরলোক গমন করেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একটি শহরের পাশাপাশি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবনের এই শহরের নামকরণ হয় ক্যানিং।
শতাব্দী প্রাচীন সেই ঐতিহ্যবাহী বিলাশবহুল বাড়িটি থেকে হারিয়ে গিয়েছে লর্ড ক্যানিংয়ের সেই সব অতীত স্মৃতি।মাতলা নদীর তীরে বিশেষ স্থাপত্য পদ্ধতি অবলম্বন করে তৈরী হয়েছিল দোতলা বাড়ীটি।বিলাশবহুল বিশাল বাড়িটির সামনে ছিল সিংহদূয়ার,কেয়ারি ফুলের বাগান আর সবুজ ঘাসের লন এবং ওপনিবেশি স্থাপত্যের খিলান যুক্ত।
মাতলা নদীতে জোয়ারের সময় জল বাড়লে সেই জল এই বাড়ির নীচে খিলান থেকে বেরিয়ে যেত বিশেষ পদ্ধতির জন্য।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্যানিংয়ে অন্যান্য বাড়ি গুলি ভেঙে পড়লেও,আজ অবধি ব্রিটিশ আমলের সর্বশেষ স্মৃতি এই বাড়িটি মরচে ধরে ধসে গেলেও ভেঙে পড়েনি।দোতলা এই বাড়ীর মধ্যে ২২ টি ঘর রয়েছে। প্রতিটি ঘরের মধ্যে ছিল একাধিক ইতিহাস।প্রথম তল থেকে দ্বিতীয় তলে ওঠার জন্য রয়েছে একটি দামী প্রশস্থ কাঠের সিঁড়ি। বর্তমানে সেই ইতিহাস কে ধ্বংসস্তুপ গ্রাস করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছে।
১৯৬২ সালে ক্যানিংয়ের জয়দেব ঘোষ দম্পতি মুম্বাইয়ের ‘জে এম দাতিয়াল-আরসি কুপার কোম্পানি’র কাছ থেকে কিনে নেন।ঘোষ দম্পতির ছেলে বরুণ ঘোষ বিশাল এই বাড়িটি তেমন ভাবে রক্ষণাবেক্ষন এবং পরিচর্যা করতে সক্ষম হতে পারেননি।জানা যায় এক সময় এই বিলাশবহুল বাড়িটি হোটেল তৈরী করার জন্য কিনতে চেয়ে জয়দেব ঘোষ কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন চিত্রাভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী।আবার সাহারা ইন্ডিয়া গোষ্ঠীও বাড়ীটি কিনতে চেয়েছিল।কিন্তু জয়দেব বাবু বিক্রি করেননি।বিশাল বাড়ীতে বসবাস করতেন জয়দেব ঘোষ ও তার স্ত্রী শিখা ঘোষ। এই বিলাশবহুল বাড়ির ১৫ টি ঘরের মধ্যে দূর্মূল্য বই,বেলজিয়াম কাঁচের নকশা করা আয়না,মেহগণি কাঠের তৈরী টেবিল,ইংল্যান্ডের লরেন্স অ্যান্ড মেয়ো কোম্পানির টেলিস্কোপ সহ অন্যান্য দামি আসবাব পত্র ঘরের মধ্যে রেখে তালা মেরে দিয়েছিলেন।পরবর্তী ঘোষ দম্পতি পরলোক গমন করায় বাড়ি টি অভিভাবক হীন হয়ে পড়ে।
অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ২০০১ এর আইন অনুযায়ী হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষনা করেন ২০১৮ সালে। এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে ঐতিহ্যশালী ভবনের স্বীকৃতি দেয়।বর্তমানে সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্তীর পথে ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক ভবনটি।
উল্লেখ্য সুন্দরবনে বেড়াতে আসা দেশবিদেশের পর্যটকরা আজও ঐতিহাসিক এই ভগ্ন বাড়িটি দর্শন করে সুন্দরবন ঘুরে যায়।বাড়িটি সম্পূর্ণ সংস্কার হয়ে গেলে প্রচুর সংখ্যক দেশবিদেশের পর্যটকদের আনাগোনা হবে বলে মত স্থানীয়দের।পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যাপারটাও প্রসারিত হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct