সুভাষ চন্দ্র দাশ, ক্যানিং, আপনজন: পশ্চিমবঙ্গের জ্বলন্ত দীপ শিখা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ইহলোক ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য’র বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। একদিকে তিনি ছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য’র ভাইপো। অপরদিকে তাঁর পরিচয় ছিল সাহিত্যিক,নাট্যকার এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি সহজেই মানুষের হৃদয় জয় করে নিতেন।আজ তিনি নেই!কিন্তু তাঁর সুকর্মের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন সুন্দরবন আজ আলোকিত।তাঁর চেষ্টায় সুন্দরবনের লাখো লাখো মানুষজন আজ সহজেই এক দ্বীপ থেকে অপর দ্বীপে যাতায়াত করতে পারছেন।চোখ মুছতে মুছতে এমন সব স্মৃতির কথা জানাচ্ছিলেন একদা বাম আমলের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সুন্দরবনের ভূমিপুত্র সুভাষ নস্কর।
তিনি আরো বলেন, প্রত্যন্ত সুন্দরবন। যাতায়াতের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন উন্নয়ণ নেই।সন্ধ্যা ঘনালেই অন্ধকারাচ্ছন।আলোকিত হয়ে উঠতো জোনাকি পোকার আলোয়, কখনও বা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়। সুন্দরবনের সুখ দুঃখ বুঝেছিলেন বুদ্ধবাবু।২০০২ সালে ২ জানুয়ারী থেকে ৮ জানুয়ারী পর্যন্ত সুন্দরবনের বুকে সর্ব প্রথম ‘বনবিবি’ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন তৎকালীন বাম আমলের মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলী।২ জানুয়ারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুন্দরবনের গোসাবার রাঙাবেলিয়াতে ‘বনবিবি’ অনুষ্ঠানের সূচনা করতে কলকাতা থেকে কনভয়ে চেপে রওনা দিয়েছিলেন।সেই সময় বাসন্তী হাইওয়ের ঢুঁড়ি থেকে সোনাখালি বাজার পর্যন্ত প্রায় ২০ কিমি রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার স্কুল ছাত্রছাত্রী ও গ্রামবাসীরা বিদ্যুতের দাবীতে ‘বিদ্যুৎ চাই’ লেখা প্লাকার্ড হাতে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য’র দৃষ্টি আকর্ষণ করে।তিনি কনভয় থেকে নেমে তাদের কে আশ্বস্থ করে বলেছিলেন ‘অপেক্ষা করুন,তিন মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিষেবা পৌঁছে দেবো।’
সেদিনের সেই কথা অনেকেই উপহাস্য করেছিলেন। তবে কথা রেখেছিলেন তিনি।২০০২ সালে ২ এপ্রিল বাসন্তীর সোনাখালিতে একটি অনুষ্ঠান বুদ্ধবাবু সুইচ টিপে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপে বিদ্যুতায়ন করেছিলেন।সেদিনের ঘটনা আজ প্রতিটি সুন্দরবনবাসীর হৃদয়ের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনের মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা সম্পূর্ণ উপলব্দ্ধি করেছিলেন।আর সেই কারণেই তাঁরই আমলে সুন্দরবনের অন্যান্য বিভিন্ন দ্বীপে দ্বীপে পৌঁছে গিয়েছিল বিদ্যুতের আলো।সেই থেকেই আলোকিত হয়ে উঠেছিল সুন্দরবন।পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনে লাখো লাখো মানুষ নদীতে কাদায় গদ মাড়িয়ে যাতায়াত করতো।সেই দৃশ্যও তিনি উপলব্দ্ধি করেছিলেন। সুন্দরবনের মানুষের যাতায়াতের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার ক্যানিংয়ের মাতলা নদীর উপর ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে বিরাট সেতু তৈরী করেছিলেন।এমনকি সেই সেতু তিনি নিজে হাতেই ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারী সুন্দরবন বাসীর উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য’র ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে সুন্দরবনবাসী আজ অনেকখানি এগিয়ে।২০০৯ সালের ২৫ মে আয়লায় বিপর্যস্ত হয়েছিল সুন্দরবন।সুন্দরবন মানুষের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছিলাম তাঁর কাছে। তিনি দরাজ হস্তে সামাল দিয়ে সুন্দরবন বাসীদের কে আশ্বস্থ করেছিলে।সুন্দরবনে প্রতিবছরই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে।প্রাণহানী হয় বাসস্থান হারায় মানুষজন। সেই কথা মাথায় রেখে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সুন্দরবনের প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় ‘আয়লা সেন্টার’ করার কথা বলেছিলাম। যেখানে বিপর্যয়ের সময় মানুষ নিরাপদে থাকবে। তিনি সেটাও বাস্তবায়িত করেছিলেন। সুন্দরবন নিয়ে যতবার যত আবদার কিংবা আবেদন করছিলাম তিনি সমস্ত কিছুরই সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।তিনি আজ নেই!ভাবতে কষ্ট হচ্ছে!তবে তিনি সুন্দরবনের প্রায় পঞ্চাশ লাখ মানুষের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct