সুব্রত রায়, কলকাতা, আপনজন: আজ মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা । রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিরোধী দলনেত্রী। সিঙ্গুরে অনিচ্ছাকৃত কৃষকদের জমি ফেরত দিতে হবে এই দাবিকে সামনে রেখে জাতীয় সড়কের ওপরে চলছে জোরদার অবস্থান আন্দোলন। গোটা সিঙ্গুর ন্যানো কারখানার প্রকল্পিত জমি ঘিরে রেখেছে হাজার হাজার পুলিশ। মঞ্চে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিয়মিত সেই আন্দোলনের রিপোর্টিং করতে প্রতিদিন যেতে হতো কলকাতা থেকে সিঙ্গুরে। হঠাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চ থেকে উঠে পাশে থাকা তার একটি ছোট্ট পোশাক বদলের কক্ষে চলে গেলেন।। মঞ্চে তখন অন্যান্য আন্দোলনকারীরা জোরদার বক্তব্য রাখছেন। বিষয়টি কি সাংবাদিক হিসেবে কৌতূহলের সঙ্গে অনুসন্ধান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সেই সময় তৃণমূল নেত্রীর ঘনিষ্ঠ এক মহিলা নেত্রী যিনি পরবর্তীকালে রাজ্যের বিধায়ক হয়েছিলেন তার মারফত জানতে পারলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলন মঞ্চ থেকে কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কোথায় যাবেন তিনি? জানতে পেরেছিলাম যাচ্ছেন রাজ ভবন। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী ডেকে পাঠিয়েছেন । সাংবাদিক হিসেবে আগাম সেই খবর টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচার করে ফোন ইন দিতে দিতে গাড়ি নিয়ে ছুটেছিলাম রাজ ভবনের গেটে। সেই সময় রাজভবনের অধীনে থাকা হেয়ার স্ট্রিট থানার ওসি প্রেমব্রত মজুমদার এবং তৎকালীন হেয়ার স্ট্রিট থানার সেকেন্ড অফিসার শান্তনু সিনহা বিশ্বাসকে দেখলাম পুলিশ ফোর্স নিয়ে রাজভবনের গেটে তৎপর। পরবর্তীকালে প্রশাসন সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, রাজভবনের ভেতরে হল ঘরে পাতা হয়েছে একটি বড় টেবিল। তাতে সাদা কাপড় এনে বিছান হয়। আমাদের সাংবাদিকদের রাজভবনের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই রাজ ভবনের হলঘরে টেবিলের মাঝে বসে ছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী। রাজভবনে একে একে প্রবেশ করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাদেরকে পাশে বসিয়ে তৎকালীন রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত করেছিলেন সিঙ্গুর জমি জটকে সামনে রেখে। ওই চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছিল অনিচ্ছাকৃত কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের জমি জোর করে না নিয়ে সিঙ্গুর প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে উভয়পক্ষ সচেষ্ট থাকবেন। খুব কাছ থেকে সেদিন বুদ্ধবাবুকে দেখেছিলাম। এতোটুকু বিচলিত নন। রাজ্যপালের নির্দেশ মেনে স্বাক্ষর করেছিলেন সেই চুক্তিপত্রে। পরবর্তীকালে সেই চুক্তি মানা হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেদিন রাজভবনের গোটা হলঘরটা নিস্তব্ধ ছিল। শাসক এবং বিরোধীপক্ষ মুখোমুখি হাজির ছিলেন। কিন্তু সিঙ্গুর আন্দোলন মঞ্চে উত্তেজনা থাকলেও তার আঁচ কিন্তু এসে আঘাত করতে পারিনি রাজভবনের অন্দরমহলকে। সেই চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তৎকালীন রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কি বিষয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো এবং আগামী দিন রাজ্যের শাসক দল ও বিরোধী দলের সিঙ্গুর জমি জট বিতর্ক নিয়ে কি ভূমিকা হবে তা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করতে শোনা গিয়েছিল। বুদ্ধবাবু তার সাদা পাঞ্জাবির পকেটে থাকা কলমটি বের করে সেই চুক্তিপত্রে যখন স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই সময় রাজভবনের ফল ঘরে উপস্থিত আলোকচিত্রীদের ফ্ল্যাশ গান মুহুর্মুহু ঝলসে উঠেছিল। আরেকটি দিন বুদ্ধ বাবু কে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম আমি। সেই দিনটি ছিল ২০১১ সালের ১৩ ই মে। রাজ্যের সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর দুপুর নাগাদ নিজের গাড়িতে চেপে পৌঁছেছিলেন রাজভবনে। দিনটি ছিল শুক্রবার। নিজের হাতে পদত্যাগ পত্র পৌঁছে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল এম কে নারায়নের হাতে। সকাল থেকে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার সময় আমার ডিউটি ছিল কালীঘাটে। কিন্তু হঠাৎ খবর আসে বুদ্ধবাবু পদত্যাগ করতে রাজভবনে যাচ্ছেন। সেদিন বুদ্ধ বাবু ফলাফল প্রকাশের পর এক মুহূর্ত দেরি না করে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজভবনে। সেখানে ছয় থেকে সাত মিনিট ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। তৎকালীন রাজ্যপাল এম কে নারায়ন পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী শপথ না নেওয়া পর্যন্ত তাকে দায়িত্বভার পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বুদ্ধবাবু মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে গাড়িতে চেপে উত্তর দিকের গেট দিয়ে বেরোনোর সময় সাংবাদিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধবাবুর বক্তব্য জানার জন্য। তিনি কোন বক্তব্য দেননি। মাথা নিচু করে বসেছিলেন সাদা এম্বাসেডর গাড়ির পেছনের ধবধবে সাদা পাতা তোয়ালের ওপর। গাড়ি চালক ওসমান রাজভবনের গেটে গাড়ির গতি কিছুটা কমিয়ে যখন বুঝতে পেরেছিলেন সাহেব কিছু বলবেন না বেরিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে।
রাজভবনের গেটে দাঁড়িয়ে সাদা এম্বাসেডরের হালকা সবুজ রং এর কাচের ফাঁক দিয়ে বুদ্ধবাবুকে দেখেছিলাম পরাজয়ের গ্লানি মুখে নিয়ে তিনি খুব ক্লান্ত। কিন্তু জনগণের রায় মেনে নিয়ে মহাকরণ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর বুদ্ধবাবুকে আবার সাংবাদিক হিসেবে দেখেছিলাম ২০১১ সালের ২০ মে, রাজভবনে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অষ্টম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানে। গোটা অনুষ্ঠানটিতে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে সামনের সারির আসনে বসে গালে হাত দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত চাক্ষুষ দর্শন করতে দেখা গিয়েছিল সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিহিত রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে। শপথ নেওয়ার পর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এগিয়ে গিয়েছিলেন তার দিকে এবং হাত তুলে নমস্কার জানিয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনিও শুভেচ্ছা বিনিময় করেছিলেন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে। যা কিনা নজির হয়ে রয়েছে রাজভবনের ফটো এ্যালবামে। সাদা পাজামা অথবা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিহিত বাংলার এই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে বিধানসভার ভেতর তৎকালীন বিরোধী বিধায়করা দোয়াতের পেন ভর্তি কালি এনে ছিটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মেজাজ হারাননি সাহিত্য প্রেমি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম ও নেতাই কাণ্ডে বিরোধীদের আন্দোলনে বৃদ্ধ হওয়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সমালোচিত হলেও তার প্রশাসনিক দক্ষতা ও সততা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানার প্রকল্পে তার পিছিয়ে আসা বাংলার শিল্পমহলে কতটা আঘাত এনেছে তা হয়তো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে। কিন্তু আবৃত্তিকার, সাহিত্যপ্রেমী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেকোনো কোরাপশনের উর্ধ্বে উঠে থাকবেন ধবধবে সাদা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct