এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: ২০১০ সালে মাদ্রাসাগুলিতে গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের জন্য প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বসেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথির বাসিন্দা মির্জা আব্দুর রহমান বেগ । প্রিলিমিনারিতে সফল হয়ে ২০১১ সালে লিখিত পরীক্ষায়ও বসেন তিনি। তার পর প্রায় ১৪ বছর কেটে গেলেও আজ পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল না। ইতিমধ্যেই অকাল মৃত্যুতে পরকালে পাড়ি দিয়েছেন মেধাবী শিক্ষার্থী মির্জা আব্দুর রহমান বেগ। রাজ্যের শিক্ষা মানচিত্রে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম দুর্নীতি এবং সরকারি উদাসীনতার দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ বলে মনে করছে শিক্ষানুরাগীরা।
আব্দুর রহমানের ভাই মির্জা আর কে বেগ আপনজন প্রতিনিধিকে জানান, ‘আমরা তিন ভাই এবং ভাবি মাদ্রাসার গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বসে ছিলাম, সকলেই পাশ করি, পরবর্তীতে ২০১১ সালে লিখিত পরীক্ষায়ও দেই। তবে চূড়ান্ত রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই ২০১৫ সালে ব্রেইন টিউমারে দাদা মির্জা আব্দুর রহমান বেগের মৃত্যু হয়। এক ছেলে এক মেয়ে এবং স্ত্রীকে রেখে দাদা পরকালের পাড়ি দেন।’ সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগের ক্ষেত্রে তৎপরতা গ্রহণ করেছে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন, বিজ্ঞপ্তি জারি হতেই ভেঙে পড়েছে আব্দুর রহমানের পরিবার, পরিবারের কথায় সঠিক সময় নিয়োগ হলে, হয়তো এ দুর্ঘটনা ঘটতো না, এত বছর পর নিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও আজ আর মির্জা আব্দুর রহমান বেগ বেচে নেই। ভাই আর কে বেগ আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারি নিয়োগ দীর্ঘদিন বন্ধ, প্রচুর শূন্য পদ থাকলেও নিয়োগ বন্ধ, সরকার দিশেহারা। সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, এই সরকারের কাছে আমরা এটা আশা করিনি, সরকারের সদিচ্ছা নেই, সরকারি গাফিলতির শিকার হয়েছে আমার দাদা, স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভেঙে পড়েছি।’
উল্লেখ্য এসএসসি থেকে মাদ্রাসা, নিয়োগের জট আর কাটছে না রাজ্যে । একবছর বা দুবছর নয় । টানা প্রায় চৌদ্দ বছর অপ্রকাশিত মাদ্রাসা গ্রুপ-ডি পদের রেজাল্ট। কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও দায়ের চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষ থেকে। শুনানি চলাকালীন মাদ্রাসা বোর্ডের তরফ থেকে ফের পরীক্ষা নেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছিল । তা খারিজ করে দেয় কলকাতা হাইকোর্ট । সম্প্রতি বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ ওই পরীক্ষার ফলাফল তিন মাসের মধ্য প্রকাশের পাশাপাশি ২ লক্ষ টাকা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনকে ।
২০১০ সালের নভেম্বর মাসে মাদ্রাসাগুলিতে গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের জন্য প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয় । পরীক্ষায় বসেন প্রায় পাঁচ লক্ষ ছেলে মেয়ে। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের মার্চ মাসে সফল ৯৮৫৫৫ জনের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় ওই চাকরিপ্রার্থীদের । তার পর প্রায় ১৪ বছর কেটে গেলেও আজ পর্যন্ত ঠিক করে ফল জানতে পারেননি পরীক্ষার্থীরা । প্রথমে পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ফল প্রকাশ বন্ধ রাখা হয়েছিল । পরে এই নিয়ে অনেক মামলা হয় আদালতে । বিচারাধীন বিষয় হওয়ায় মামলাগুলির নিষ্পত্তির আগে ফল প্রকাশ করা যাচ্ছিল না। বন্ধ ছিল নিয়োগ প্রক্রিয়াও।
২০১০ সালে বাম আমলে মাদ্রাসার গ্ৰুপ-ডি পদে কর্মী নিয়োগের পরীক্ষা হয় । জানানো হয়, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৩০০০ কর্মী নিয়োগ করা হবে। সিংহভাগ পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘ মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন ইচ্ছাকৃত গড়িমসি করছে নিয়োগ ব্যাপারে’। মামলাকারীরা ডিভিশন বেঞ্চকে জানিয়েছেন, -‘২০১৯ সালে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার সিঙ্গেল বেঞ্চ ওই শূন্যপদ ১৪ দিনের মধ্যে পূরণ করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছিল মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে সিঙ্গেল বেঞ্চের নির্দেশ বহাল রাখে ডিভিশন বেঞ্চ । কিন্তু তারপরেও নিয়োগ হয়নি । সেই সময় মারণ ভাইরাস করোনা পরিস্থিতির কারণে নির্দেশ কার্যকর করার জন্য আদালতের কাছে ছ’মাস সময় চেয়েছিল মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন । সেই ছ’মাস পেরিয়ে গেলে কোভিডের কারণ দেখিয়েই আরও ছ’মাস সময় নেওয়া হয় । এভাবে বেশ কয়েকবার সময় নিয়েও তিন হাজার গ্ৰুপ-ডি পদে নিয়োগ করতে পারেনি মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন ।
কমিশনের পক্ষ থেকে ১লা আগস্ট বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়েছে আগামী ১০ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট 1st SLST(NT) Group-D পরীক্ষার নিয়োগ পদ্ধতি সমাপ্ত করতে চলেছে, যদিও মেইন পরীক্ষায় সফলদের পাঁচ নম্বরের ইন্টারভিউ বাকি রয়েছে । ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সকল প্রার্থী, যাঁদের নাম এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর (জেলাভিত্তিক, বর্ণানুক্রমিকভাবে) পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন এর ওয়েবসাইট: www.wbmsc.com-এ বিজ্ঞপ্তি আকারে দেওয়া রয়েছে, তাঁরা যেন অবশ্যই ০২.০৮.২০২৪ তারিখ থেকে ০৯.০৮.২০২৪ তারিখ, (শুক্রবার) রাত্রি ১১টা ৫৯ মিনিট এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন এর ওয়েবসাইট www.wbmsc.com -এ, ‘Online Updation Portal of 1st SLST(NT)-Group-D’-এ নিজের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও ইংরেজি জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করে ১. Email Id, ২. মোবাইল নম্বর, ৩. হোয়াটস্যাপ নম্বর, ৪. আধার নম্বর, ৫. যোগাযোগের জন্য বর্তমান ঠিকানা, এবং ৬. আধার কার্ড Update/Upload করেন। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের তরফে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়ায় কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছেন কয়েক হাজার চাকরিপ্রার্থী, এখন দেখার শেষ পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় কিনা।
অন্যদিকে, চাকরি পাওয়ার আগেই মৃত মির্জা আব্দুর রহমান বেগ সম্বন্ধে শিক্ষাবিদ কামাল হোসেন বলেন, ‘চাকরিপ্রার্থী মির্জা আব্দুর রহমান বেগ মারা গেলেন ৷ সঠিক সময়ে নিয়োগ হলে বেশ কয়েক বছর চাকরি করতে পারতেন, পাশাপাশি চাকরি করতে করতে মারা গেলে পরিবারেরও চাকরি সুনিশ্চিত হতে পারতো, সবকিছু থেকে তারা বঞ্চিত হল ৷ এর দায়ভার কে নেবে ? এর দায়ভার সংখ্যালঘু দপ্তরকেই নিতে হবে, কারণ মাদ্রাসা বিভাগটির সংখ্যালঘু দপ্তরেরই অংশ ৷’ মাদ্রাসাগুলিতে গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের জন্য ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হওয়া প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় সফল হওয়া ৯৮ হজার ৫৫৫ জন চাকরিপ্রার্থী সরকারের উদাসীনতায় আইনি জটিলতার কারণে এতগুলো বছর হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে মনে করছেন কামাল হোসেন ৷ সংখ্যালঘুদের প্রতি কেন এত উদাসীনতা সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি ৷ মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনকে টার্গেট করে প্রশ্ন তোলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কামাল হোসেন ৷ বলেন, দুর্নীতি না থাকলে সঠিক সময়ে ফল প্রকাশ এবং নিয়োগে কেন এত দেরি হবে ৷ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাঁকে টেলিফোনে পাওয়া যায়নি ৷
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct