এম ওয়াহেদুর রহমান, আপনজন: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন ভারতীয় রসায়নের জনক, অন্যতম দেশপ্রেমিক , শিক্ষক, দার্শনিক ও কবি। তিনি বাঙালি জনগণের হৃদয়ে পি সি রায় নামে ও পরিচিতি লাভ করেছিলেন।আজ আমরা যে মার্কারি ( l ) নাইট্রেট কিংবা মারকিউরাস নাইট্রেট ( Hg No2 ) ব্যাবহার করি তা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আবিষ্কার করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি রসায়নবিদ বা বিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্ব মাঝে খ্যাতি অর্জন করলেও তাঁর অন্তরে গ্ৰোথিত ছিল দেশপ্রেম। বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেখানে দেশবাসী জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হবে। তার সাথে সাথে বিদেশি পন্য বর্জন করে দেশজ পন্য ব্যবহারে উপযোগী হয়ে উঠবে।তাই তিনি বলেছিলেন, ‘ দেশের জন্য প্রয়োজন হলে বিজ্ঞানীকে টেস্ট টিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে
হবে। বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজের জন্য সংগ্ৰাম অপেক্ষা করতে পারে না।’
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন বনেদি পরিবারের সন্তান। তিনি ছেলেবেলা থেকেই সব বিষয়ে তুখোড় তথা প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন। শিক্ষকতার জন্যই তিনি ‘আচার্য ‘ হিসেবে আখ্যায়িত হন। আচার্য দেবের দেশপ্রেম তাঁকে ইউরোপ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। দেশে এসে ও তিনি তাঁর স্বদেশ প্রীতির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি শ্রেনি কক্ষে ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় লেকচার দিতেন। কেননা বাংলা ভাষা তাঁর অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিল। তিনি তাঁর অসাধারণ বাচনভঙ্গির দ্বারা ছাত্র - ছাত্রীদের মন অনায়াসেই জয় করে নিতেন। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত উৎসাহীও নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী সর্বোপরি উদারপন্থী।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী। ব্রিটিশদের দমন - পীড়ণ নীতির ফলে ভারতীয় সমাজের যে অবনতি ঘটেছিল তা তিনি জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তার কারখানায় তাদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দেশের প্রতি প্রেম সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিন্তায় তিনি মগ্ন থাকতেন। তিনি মারকিউরাস নাইট্রেট ছাড়া ও বারোটি যৌগিক লবণ এবং পাঁচটি থায়োএস্টারের আবিষ্কারক ছিলেন। তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল ভারতের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্জল। একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হয়ে ও তিনি স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে তাঁর নাম লেখা হয়েছিল ‘ বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী ‘। তিনি কিংবদন্তি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কারণ তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের অস্ত্র কেনার টাকা দিতেন।বিজ্ঞান কলেজে ও পাঠদান কালে তিনি যে বেতন পেতেন তার অধিকাংশই দান করে দিতেন ছাত্র - ছাত্রীদের উন্নতির জন্য। ১৯২২ সালের উত্তরবঙ্গের ভয়ঙ্কর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তিনি তাঁর সর্বস্ব দান করে দিয়েছিলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় গান্ধীজির নীতি অনুসরণ করে অবসর সময়ে চরকা দিয়ে সুতো কাটতেন। তিনি দারিদ্র্য বিমোচনে দরিদ্র মানুষের সেবা করেছেন নির্দ্ধিধায়। দেশের মাটি ছিল তাঁর আত্মার অন্তরের অন্তঃস্থলে। তাই তিনি দেশিয় পন্যের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি দেশিয় শিল্পের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ পড়, কারিগরি শিক্ষা অর্জনের জন্য, চাকরি না করে ব্যাবসা করো , একটা জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা মসীজীবী হয়ে টিকে থাকতে পারেনা। বিজ্ঞান চর্চার সুফল তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন গণমানুষের নিকটে। তাঁর জীবনের সবটুকু জুড়েই ছিল এ দেশের মানুষ। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় অনেক মাসিক পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থাপন করলেও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে বাংলায় অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘ লাইফ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স অফ আ বেঙ্গলি কেমিষ্ট ‘ দুটি খন্ডে প্রকাশ করে ভারতীয় যুবকদের উৎসর্গ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি লিখেছিলেন ‘ A History of the Hindu Chemistry from the Earliest Times to the Middle of Sixteenth century(1902)
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন অত্যন্ত মানবিক, যুক্তিনির্ভর তথা অসাম্প্রদায়িক। তিনি বলতেন সবার আগে মানুষ, তারপরে ধর্ম।রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়,ছাত্র - ছাত্রীদের মনে ধর্মান্ধতার মূল শেকড় উপড়ে ফেলে ছিলেন তিনি। বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা ইত্যাদি সামাজিক প্রতিবন্ধকতা গুলিকে তিনি ঘৃণা করতেন।অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদে সামিল হতেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী বীরদের প্রতি তাঁর গভীর সহানুভূতি ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজির খদ্দর প্রচারের উদ্যোক্তাদের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। তিনি দেশে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন,পরাধীন ভারতে এনেছিলেন কর্মের উদ্দীপনা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানের রহস্যময় পথ দিয়ে দেশের সেবা করা , স্বদেশী আন্দোলন পরিচালনা ও বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলা। তাই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ প্রেম রসায়নে ওগো সর্বজন প্রিয়, করিলে বিশ্ব জনে আপন আত্মীয়।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct