আপনজন ডেস্ক: ফ্রান্স অলিম্পিক ফুটবল দলের অধিনায়ক জ্যঁ-ফিলিপে মাতেতা তাহলে আর্জেন্টিনাকে একরকম হুমকিই দিয়ে রাখলেন!
দেওয়ারই তো কথা। আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়, সমর্থক থেকে শুরু করে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট—কোপা আমেরিকা জয়ের পর ফ্রান্স দলকে নিয়ে তাঁরা যেভাবে অপমানজনক ও বর্ণবিদ্বেষী ভাষায় গান গেয়েছেন ও মন্তব্য করেছেন, তাতে ফরাসিদের ক্ষোভে ফেটে পড়াই স্বাভাবিক।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে এরই মধ্যে ফ্রান্স সরকারের কাছে ক্ষমাও চেয়েছে আর্জেন্টিনা সরকার। কিন্তু ক্ষোভের আগুন কি এত সহজে নেভে! যাদের সঙ্গে বিবাদ, এবার তাদের যদি ঘরের মাঠে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া যায়, তাহলে সবকিছুর উচিত জবাব দেওয়ার মোক্ষম সময় তো এটাই। সেই সুযোগ পেয়েই গেল ফ্রান্স। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স এবার প্যারিস অলিম্পিক ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি। আগামী শুক্রবার রাতে বোর্দোয় সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে দুই দল।
মার্শেইয়ে গতকাল রাতে নিউজিল্যান্ডকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ‘এ’ গ্রুপের শীর্ষ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে স্বাগতিকেরা। লিওঁতে এর আগে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে ইউক্রেনকে হারিয়ে ‘বি’ গ্রুপ থেকে শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছে।
তবে আর্জেন্টিনা হয়েছে গ্রুপ রানার্সআপ; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মরক্কো। দুই দলেরই পয়েন্ট ও গোল পার্থক্য সমান হলেও মুখোমুখি দেখায় আশরাফ হাকিমিদের কাছে নাটকীয়ভাবে ২-১ গোলে হেরে গিয়েছিলেন হুলিয়ান আলভারেজ-নিকোলাস ওতামেন্দিরা। এ কারণে ‘বি’ গ্রুপের রানার্সআপ হিসেবে হাভিয়ের মাচেরানোর দলকে শেষ আটে খেলতে হচ্ছে ‘এ’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন থিয়েরি অঁরির ফ্রান্সের বিপক্ষে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কাল প্রথম গোলটি ফ্রান্স অধিনায়ক মাতেতাই করেছিলেন। সব মিলিয়ে অলিম্পিক ফুটবলে বেশ ছন্দেই আছে ফরাসিরা। তিন ম্যাচে দলটি করেছে ৭ গোল; বিপরীতে গোল খায়নি একটিও। কোয়ার্টার ফাইনালে তাই আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থেকেই খেলতে যাচ্ছে স্বাগতিকেরা। আর প্রতিপক্ষ যখন আর্জেন্টিনা, তখন ফরাসিদের আরও তেতে থাকার কথা।
মাতেতা কাল সে কথাই বলেছেন, ‘সম্প্রতি যা ঘটেছে, ফ্রান্সের সবাই তাতে আক্রান্ত হয়েছি। তাই এবার আমরা দেখব কোয়ার্টার ফাইনালে কী হয়।’ তবে আর্জেন্টিনাকে সমীহও করছেন ইংলিশ ক্লাব ক্রিস্টাল প্যালেসের এই স্ট্রাইকার, ‘আর্জেন্টিনা বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং ওরা এমন একটা দল, যারা সব টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে। তবে আগে আমরা (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) জয় উদ্যাপন করব। এরপর ওদের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে ভাবব।’
কোপা আমেরিকা, ফিনালিসিমা, বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা—গত তিন বছরে চারটি শিরোপা জেতার পর আর্জেন্টিনার চোখ এখন প্যারিস অলিম্পিকের সোনার পদকে। ২০০৪ ও ২০০৮ সালে টানা দুবার অলিম্পিক ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দলটি।
এরপর সোনা দূরে থাকা, তারা আর কোনো পদক পায়নি। ১৬ বছরের আক্ষেপ এবার ঘোচাতে চান হুলিয়ান আলভারেজ। কাল ইউক্রেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর ম্যানচেস্টার সিটির এই আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড স্বদেশি ক্রীড়াবিষয়ক টিভি চ্যানেল টিওয়াইসি স্পোর্টসকে বলেছেন, ‘আমরা হার দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেই হার নিয়ে সত্যিই খুব রাগান্বিত ছিলাম। এরপর আমরা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। ফ্রান্স স্বাগতিক। তাই আমরা জানি ওদের বিপক্ষে খেলার অর্থ কী। তবে ফাইনালে যেতে হলে আমাদের সামনে যারাই পড়বে, তাদেরকেই হারাতে হবে।’
আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স ভিন্ন মহাদেশের দল হওয়ায় তাদের খুব একটা দেখা হয় না। দল দুটি সর্বশেষ মুখোমুখি হয়েছিল ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে। লুসাইলের সেই ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা। এরপরই আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা ফ্রান্স দলকে নিয়ে অপমানজনক ও বর্ণবিদ্বেষী ভাষা ব্যবহার করে গানটি গাইলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হয়।
সেই গানে ফ্রান্সের তারকা স্ট্রাইকার ও বর্তমান অধিনায়ক কিলিয়ান এমবাপ্পেকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা হয় এবং আরও কয়েকজন ফরাসি খেলোয়াড়কে ‘অন্য দেশ থেকে আগত’ সম্বোধন করা হয়। আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ এমবাপ্পের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে বিদ্রূপও করেন। সে সময়ও ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে (এএফএ) চিঠি পাঠিয়েছিল ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশন (এফএফএফ)। ফ্রান্সের ক্রীড়ামন্ত্রীও মার্তিনেজের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এবার আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকা জয়ের পর দলটির মিডফিল্ডার এনজো ফার্নান্দেজ টিম বাসে সেই গান গেয়ে পুরোনো বিতর্ককে নতুন করে উসকে দেন। শুধু তা-ই নয়, ফার্নান্দেজকে সমর্থন জানিয়ে আর্জেন্টিনার ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিক্তোরিয়া ভিয়ারুয়েল ফ্রান্সকে ‘ঔপনিবেশিক’ ও ‘দ্বিচারী’ রাষ্ট্র বলেন।
ফার্নান্দেজের বর্ণবিদ্বেষী গান নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষমা চেয়ে নেন। ফরাসি দূতাবাসে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিয়ারুয়েলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চায় আর্জেন্টিনা সরকারও। আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর আমন্ত্রণে প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও হাজির হন।
তবে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি যেহেতু ফুটবল থেকেই শুরু হয়েছে, তাই এবার হয়তো অলিম্পিক ফুটবলেই এর শেষ দেখে ছাড়বে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct