সাচার কমিটির অনুসন্ধানের পর ভারতীয় মুসলমান সমাজের চক্ষুপর্দা উন্মোচিত হয়। তারপরও অতিক্রম হয়ে গেছে প্রায় ২ দশম সময় তা সত্ত্বেও মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।আজও সাচার কমিটির দেওয়া পরামর্শ ইমপ্লিমেন্টেড হয়নি ভারতবর্ষে ও বিভিন্ন রাজ্যে। কমিটির রিপোর্টে ভারতে বসবাসকারী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সরকারি চাকরিতে অবস্থান প্রকাশ পায়। যেখানে বলা হয় দেশের আদিবাসী, তপশীলি জাতির চেয়েও শোচনীয় অবস্থা ভারতীয় মুসলমানদের। লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইসমাইল।
সাচার কমিটির অনুসন্ধানের পর ভারতীয় মুসলমান সমাজের চক্ষুপর্দা উন্মোচিত হয়। তারপরও অতিক্রম হয়ে গেছে প্রায় ২ দশম সময় তা সত্ত্বেও মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আজও সাচার কমিটির দেওয়া পরামর্শ ইমপ্লিমেন্টেড হয়নি ভারতবর্ষে ও বিভিন্ন রাজ্যে। কমিটির রিপোর্টে ভারতে বসবাসকারী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সরকারি চাকরিতে অবস্থান প্রকাশ পায়। যেখানে বলা হয় দেশের আদিবাসী, তপশীলি জাতির চেয়েও শোচনীয় অবস্থা ভারতীয় মুসলমানদের। তা নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে যায় এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি ও রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসে। মুসলমানদের ওপর বঞ্চনার কাহিনি প্রকাশ পায় সাচার কমিটির রিপোর্টে।
সত্যি সত্যি একটি জাতি এত স্বল্প সময়ে সমস্ত ক্ষেত্রে দ্রুত পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে লোক দেখানো ব্যস্ত হয়ে পড়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। কমবেশি সকলেই অবগত, কেন মুসলমান, তপশিলি জাতি ও আদিবাসীরা পিছিয়ে আছে। বর্তমান বিশ্বে সংখ্যা নয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাই হলো সমাজ ও জাতি উন্নয়নের মেরুদন্ড। আর ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে জাতপাত ও ধর্মের রাজনীতি হয়। তাই দেশে জাতপাত গত উন্নয়ন ও সম্প্রদায় ভিত্তিক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয় স্পষ্টভাবে। বিভিন্ন ক্ষেত্র ও গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক আদান প্রদানের মাধ্যমে বিশেষ সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে বহুদিন ধরে। তার শিকড় ছেড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সমভাবে বণ্টন হওয়া ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন কতটা কঠিন তা সকলের অবগত। যে দেশে ব্রাহ্মণবাণীদের দাপটে নীচু জাতের মানুষদের একদা মন্দির ও স্কুলে প্রবেশ নিষেধ ছিল - সেই দেশের সাধারণ মানুষ চাকরি ক্ষেত্রে সমমর্যাদা পাবে এমন আশা কল্পনা মাত্র। যেখানে অন্য জাত, ধর্ম ও বর্ণের লোকদের হাত থেকে জল ও খাবার গ্রহণ করতেন না। তারাই পিছিয়ে পড়া মানুষদের অফিস, আদালত, কলেজে পাশাপাশি চেয়ারে বসিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিবেন এমন টা অলীকতা। যাদের গৃহে প্রবেশ করলে গোবর জল দিয়ে পরিষ্কার করা হতো তারা সমমর্যাদা দেবে এমন আশা করা নেহাত মূর্খামি। কথাই বলে হাতে থাকে, না ভাতে মারে তা বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত আদর্শ। তাই আইনশৃঙ্খলা, অধিকার, সংবিধান সবকিছু থাকলেও কীভাবে পিছিয়ে পড়াদের সামনে আসতে না দেওয়া যায় তার সমস্ত পরিকল্পনা তৈরি করে। সংবিধানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করলেও তাদের উন্নয়ন হয়নি। আজও তারা সমাজের উচ্চ বর্গের থেকে কয়েকশ গুণ পিছিয়ে আছে অথচ তাদের ভর্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ দিয়েছে। কিন্তু দেশে উচ্চবর্ণ ও চালিকাশক্তি নতুন নতুন নিয়ম কানুন ও নানা পদ্ধতি কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে পিছিয়ে পড়া সমাজকে কীভাবে পশ্চাৎ প্রসারণ রাখা যায় তার অলিখিত ও লিখিত পরিকল্পনা তৈরি করেছে। স্বাভাবিকভাবে জানতে ইচ্ছে করে কেন আজও দেশের তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা সংরক্ষণ থাকা সত্ত্বেও উন্নয়নের আড়ালে রয়েছে? আসলে দেশের চালিকাশক্তি চার শতাংশ ব্রাহ্মণ। কেন্দ্র ও রাজ্য রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক সমস্ত কিছু তাদের দখলে। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের ৮০% সর্বোচ্চ পদে আছে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোকজন। ফলে উন্নয়ন থেকে শুরু করে সমস্ত পরিকল্পনা তাদের কেন্দ্র করে। কিন্তু ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ভোট বালাই বড় বালাই, জনগণকে ভুল বুঝিয়ে ও উন্নয়নের তিমিরে রেখে শাসন করে। কিন্তু সাচার কমিটির রিপোর্টের পর সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাজ্যগুলো ভোট ব্যাংকের কথা চিন্তা করে নড়ে চড়ে বসে। দীর্ঘ সময় ধরে বাম ও কংগ্রেসের বঞ্চনার অবসান ঘুচাতে ফন্দি করেন ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ও বিভিন্ন জাতিকে দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে সংরক্ষণের আইন প্রণয়ন করেন। প্রাথমিকভাবে সরকারি নিয়ম ও সংবিধানের নির্দেশকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ না করে পশ্চাৎ প্রসারণের উপর ভিত্তি করে আইন প্রণয়ন করেন কিন্তু বুদ্ধদেব বাবুর বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতিবাদ স্বরূপ সংখ্যালঘুরা তার সরকারকে প্রত্যাখান করেন। বামফ্রন্ট ১০% অতি অনগ্রসর ও ৭ শতাংশ অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণ পাস করেন। সেখানে ১৪৩ টি সম্প্রদায় তালিকাভুক্ত ছিল যার মধ্যে ৮৩ টি জাতি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিল।
কিন্তু ২০১১ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করেন মমতা ব্যানার্জি সংখ্যালঘু ভোটের দৌলতে। ক্ষমতায় আসীন হয়ে উন্নয়নমূলক কর্মের স্বপ্ন দেখান মুসলমানদের । ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ, নতুন মাদ্রাসার অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি, ইমাম ভাতা থেকে শুরু করে নানা প্রকল্প ঘোষণা করেন। তা দেখে মুসলমান সমাজ আপ্লুত হয়ে পড়ে ও দিদিমণি মুসলমান সমাজের নয়নের মণিতে পরিণত হয়। স্বাভাবিক ভাবে ঈর্ষার কারণ হয়ে পড়ে হিন্দু সমাজের, কারণ তারাও প্রথমে বুঝতে পারেনি মমতা দেবীর ফেক উন্নয়ন। তাই তাদের কাছে মমতা, মমতাজ বেগমে পরিণত হয়। তার ফলস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গের মতো সুস্থ রাজ্যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা ছাড়া দেয় এবং রাজ্য জুড়ে বিজেপি বিরোধী দলে পরিণত হয়। চতুর নেতা-নেত্রীরা পরিস্থিতি আঁচ করে রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেন। বিজেপি নেতাদের বিরোধী মন্তব্যের কারণে মুসলমান সমাজ নিজেদের জানমাল রক্ষা করতে একত্রিত হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে রক্ষা করার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ফলে রাজ্য থেকে নিশ্চিহ্ন হয় একাধিক রাজনৈতিক দলের।
এমন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে চতুর নেত্রী মুসলমানদের যাকাতের গুচ্ছিত সম্পদ থেকে ইমাম ভাতা চালু করেন। অসংখ্য ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে কয়েক হাজার টাকা করে মুসলমান গরিব-দুখী মানুষের গুচ্ছিত টাকা বণ্টন করে দেয়। ফলে মুসলমান সমাজ খুশি হয় ও অন্যদিকে হিন্দু, খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীদের দাবি উঠে ও পাশাপাশি প্রতিবাদ শুরু হয়, সরকারি সম্পদ থেকে কেন ধর্মীয় ইমামদের টাকা দেওয়া হবে? তারপর জানা যায় আসলে ইমাম ভাতা কোন সরকারি কোশাগার থেকে নয়, মুসলমানদের যাকাতের টাকা থেকে দেওয়া হচ্ছে। অপরপক্ষে অশিক্ষিত মুসলমানদের জন্য নতুন প্রতারণার জাল বিস্তার করেন। সংরক্ষণের নামে মুসলমান ও পিছিয়ে পড়া জাতিগুলোকে নতুনভাবে সংরক্ষণের তালিকা ভুক্ত করা হয়। যেখানে ওবিসি -এ তালিকায় আরো ৩৫ টি জাতি ও ওবিসি-বি তালিকায় ৮৫টি জাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। তবে কোন সংরক্ষণ কোটা বৃদ্ধি না করে একই খাবারে মেহমান গিরি শুরু করে। তারপরে যারা আসলে বেশি পিছিয়ে পড়া তালিকাভুক্ত ছিল তারা অগ্রসর শ্রেণীর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। আগের দশ শতাংশ কোটা বৃদ্ধি না করে আরো প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষকে আওতাভুক্ত করা হয় অথচ মুসলমান সমাজ কোন উচ্চবাচ্য না করে মেনে নেয়। তারা আজও আওয়াজ তুলেনি দশ শতাংশ কোটা বৃদ্ধি নিয়ে। সংবিধানের নিয়ম অনুসারে ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না তাই সংখ্যার অনুপাতে করা হয়নি। যদিও ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা যেত এবং পরে EWS এর জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়া হল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ৫৮ শতাংশ আসন সংরক্ষিত। সরকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ওবিসি তালিকাভুক্ত করেন তাই তারা বিপদে। হাইকোর্টের নির্দেশে মমতা দেবীর সরকারের চটজলদি তালিকাভুক্ত ওবিসি বাতিল হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে বাতিল করা হয়েছে, নতুন ভাবে নথিভুক্ত তালিকা। তা নিয়ে আজ মুসলমান সমাজ জাগ্রত এবং সাম্প্রদায়িক উস্তানি চরমে। সমস্যার মূল বিষয়ে পর্যালোচনা না করে মুসলমান সমাজের নানা সংগঠন ভুল পথে ধাবিত হচ্ছে। তারা কেউ কেউ হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে। অথচ তারা কোনোদিন উচ্চবাচ্চ্য করেনি সংরক্ষিত কোটা বৃদ্ধি নিয়ে। যদিও NCBC পশ্চিমবঙ্গের ওবিসি দের জন্য সংরক্ষিত কোটা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে ৩৫টি জাতি ও সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পূর্বে ১৪৩ টি সম্প্রদায়কে ওবিসি রাজ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল যার মধ্যে ৮৩টি জাতি/সম্প্রদায় মুসলমান ধর্মের অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে ১৭৯ টি সম্প্রদায় ওবিসি তালিকাভুক্ত তার মধ্যে ৮১ টি ওবিসি -এ তালিকাভুক্ত ও ৭৩ টি মুসলমান ধর্মের অন্তর্গত। অন্যদিকে ওবিসি বি তালিকাভুক্ত মোট ৯৮টি সম্প্রদায় যার মধ্যে ৪৫টি মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। সরকার ৩৫ টি জাত ও সম্প্রদায়কে নতুনভাবে তালিকাভুক্ত করেন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। তবে ওবিসি তালিকাভুক্ত করলেও তাদের জন্য বিন্দুমাত্র কোটা বৃদ্ধি করেনি। তা নিয়ে অগ্রসর মুসলমান সমাজ ও বুদ্ধিজীবী সংগঠন কথা বলছেন। প্রায় ৯৮% মুসলমান সংরক্ষণের আওতায় হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য শতাংশের বিচারে সংরক্ষণ দেওয়া হয়নি। ৫০ শতাংশের বেশি দেওয়া না গেলে অতি সাম্প্রতিককালে EWS এর জন্য ১০% সংরক্ষণ চালু করা হয়েছে কীভাবে? তাই ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে মুসলমান সমাজকে ব্যক্তিগতভাবে সুপ্রিম কোর্টে না গিয়ে রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। পদ্ধতিগত সমস্যা রাজ্য সরকার চাইলে কয়েক মাসের মধ্যে সমাধান করে তালিকাভুক্ত করতে পারে। সরকারি দুর্নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থায় অবৈধ নিয়োগের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকার মামলা করতে পারলে বৃহত্তর মুসলমান সমাজের জন্য নিজেদের পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান করতে এত গড়িমসি করছেন কেন? তার কারণ উপলব্ধি করতে হবে সংখ্যালঘু সমাজের বুদ্ধিমানদের। কয়েক মাসের মধ্যে যেখানে সমস্যার সমাধান করা যাবে- তা না করে, কোর্টের দরজা খটখটিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে সময় নষ্ট করতে চাইছেন কেন? সুপ্রিম কোর্টে গেলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকার সম্ভাবনা প্রবল বলে আইনজীবীদের একাংশ মনে করছে। তাই মুসলমান বুদ্ধিজীবী ও নানা সংগঠনকে সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ও রাজ্যসরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পদ্ধতিগত ক্রটি সংশোধন করাতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক,
দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct