বর্তমান সময়ের একটি জ্বলন্ত সমস্যা হচ্ছে ওবিসি শংসাপত্র সংক্রান্ত আদালতের রায় ও সেই রায়কে ঘিরে গণসংগঠন গুলোর যৌথ আন্দোলন। সম্প্রতি কলকাতা আদালতের এই রায় মূলত একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সুবিধাভোগী মুসলমান জনসমাজের ভয়ংকর ক্ষতিকর দিক। ওবিসি শংসাপত্র বহু যুবক-যুবতী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধাভোগ করছিলেন। এই রায়ের ফলে সেই সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। লিখেছেন শেখ মফেজুল হক।
বর্তমান সময়ের একটি জ্বলন্ত সমস্যা হচ্ছে ওবিসি শংসাপত্র সংক্রান্ত আদালতের রায় ও সেই রায়কে ঘিরে গণসংগঠন গুলোর যৌথ আন্দোলন। সম্প্রতি কলকাতা আদালতের এই রায় মূলত একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সুবিধাভোগী মুসলমান জনসমাজের ভয়ংকর ক্ষতিকর দিক। ওবিসি শংসাপত্র বহু যুবক-যুবতী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধাভোগ করছিলেন। এই রায়ের ফলে সেই সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। ফলে রাজ্যের সচেতন নাগরিকবৃন্দ সংরক্ষণ অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, রাজ্যের ২৩ টি জেলার মধ্যে কলকাতায় কিছু সংখ্যক সংগঠন ওবিসি সংরক্ষণ সুবিধা ফিরে পেতে আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইলেও, রাজ্যের অন্য জেলাগুলিতে এই আন্দোলনে নামার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর মধ্যে ব্যতিক্রমী জেলা মুর্শিদাবাদ। রাজ্যের রাজধানী তথা মহানগর হিসাবে কলকাতায় যেভাবে আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার কথা ছিল, তেমন ভাবে এখনো চোখে পড়েনি।কলকাতার পর
মুর্শিদাবাদ জেলাতে আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। মুর্শিদাবাদ জেলাতেই ওবিসি সংরক্ষণ অধিকার সুবিধাভোগীদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। কলকাতায় আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইলেও, আলোচনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। এখনো মিছিল পথসভা বা কনভেনশন সে ভাবে আয়োজিত হয়নি। কিন্তু যথারীতি মুর্শিদাবাদে ১৫টি সংগঠন একত্রিত হয়ে একটি কনভেনশন করে ফেলেছে। তাই স্বাভাবিক প্রশ্ন, হঠাৎই কেন এই আন্দোলন ? হঠাৎই কলকাতা হাইকোর্ট কেন এমন রায় ঘোষণা করলেন ? একটু পিছন ফিরে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে।
দীর্ঘ সময় ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই বছরের পর বছর ধরে সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন চলছে। নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত সকলেই সামাজিক নিপীড়ন বিষয়টি থেকে ক্রমশ নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তারই সাম্প্রতিক নমুনা দেখা গেল ওবিসি শংসাপত্র সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে। এই রায় বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলমান তরুণ তরুণীদের কলেজে ভর্তি হওয়া, উচ্চশিক্ষা ও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনায় সরাসরি আঘাত করেছে বলেই সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন। এই নাগরিকদের আরও বিশ্বাস, বছরের পর বছর ধরে ভারত রাষ্ট্রে এবং এই বাংলায় ধর্মের নামে, জাতের নামে যে সামাজিক নিপীড়ন চলছে, তার বিরুদ্ধে সংরক্ষণ নীতি অধিকারহীন জনসাধারণের অধিকার বলবৎ করার এক অতি সাধারন পদ্ধতি মাত্র। দেশের মুসলমান জনগণের ওপর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন যে এক ভয়ঙ্কর জায়গায় গিয়েছে, সাচার কমিটির রিপোর্টে তা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছিল। তাই ওবিসি শংসাপত্র খারিজ করা মানে এই সামাজিক নিপীড়নকেই অস্বীকার করা। সামাজিক নিপীড়নকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে দাঁড়ানো। বিপুল সংখ্যক সাধারণ মুসলমান জনসাধারণকে অধিকারহীন করে তোলা। আসলে এই রায় দেশের মুসলমান জনসাধারণের অধিকারের ওপর এক সামগ্রিক আক্রমণের অংশ।
দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে কলকাতা হাইকোর্টে এই মামলা চলছিল। হঠাৎ করে সাম্প্রতিক হয়ে যাওয়া ৫ম দফা পার্লামেন্টারি সাধারণ নির্বাচনের ঠিক তিন দিন আগে এবং ৬ষ্ঠ দফা নির্বাচনের ৮ দিন আগে লক্ষ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করে হাইকোর্টের এই রায় নিঃসন্দেহে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যমূলক। এর কিছুদিন আগে থেকেই বিজেপি’র কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতারা - ওবিসি সংরক্ষণের বিরুদ্ধে নানা সওয়াল করছিলেন। রাজ্যের সচেতন নাগরিকগণ মনে করছে, তারই ফলশ্রুতিতে রাজ্যের উচ্চ আদালতের এই রায়। এ বিষয়টা আরো সুস্পষ্ট হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে একজন মামলাকারীর বক্তব্য থেকে। বিরোধীপক্ষ বা সরকারপক্ষ যে যাই বলুক না কেন, এই সংরক্ষণ অধিকার সরকারি ভাবেই আইনি ব্যবস্থাপনায় স্বীকৃত। যা কিছু প্রশাসনিক ত্রুটি, তার দায় এবং দায়িত্ব সরকার পক্ষের। অথচ কোর্টে এই রায় অবৈধ বলে ঘোষণা করার প্রাক মুহূর্তে সরকারি আইনজীবীদের কাছে নথি চাইলে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা যথাযথ তথ্য হাজির করেননি। যথাযথ তথ্য পরিবেশন না করাকে ‘উদাসীন মানসিকতা’ বলেই সচেতন নাগরিকরা অভিযুক্ত করছেন। কিছুদিন আগে ঠিক একই ভাবে বিজেপির এক রাজ্য নেতার বক্তব্যের ঠিক পর পরই স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরিতে দুর্নীতি প্রশ্নে ‘চাল থেকে কাঁকর বাছতে না পেরে’ প্রায় ২৬০০০ শিক্ষকের সরকারি চাকরি খেয়ে নিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের এক ঘোষণায়। স্বাভাবিক ভাবেই অনেকেই মনে করছেন, এমন রায় আদালতকে প্রভাবিত করেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে।
রাজ্যের মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য, আদালতের রায় বারংবার রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হওয়াতে সচেতন নাগরিকবৃন্দ আশঙ্কিত। অনেক মানবাধিকারকর্মী সরাসরিই বলছেন- ‘ন্যায়বিচারের আশা ক্রমশ ভুলন্ঠিত হচ্ছে’। এরপরও মুসলমান জনগণ আশঙ্কিত হলেও, সংযত, কারণ কিছু কিছু রায় মানুষকে আশা জাগাচ্ছে। রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা, প্রতিবাদ করা বর্তমান সময়ে গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমী ও অধিকার আন্দোলনকারীদের এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোর্টকে কুক্ষিগত করা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ক্রমশ এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি। বহুজাতিক সংস্থার সাথে সম্প্রদায়িক আঁতাত, যা ফ্যাসিবাদ কায়েমের রাস্তাকে ক্রমশ মসৃণ করছে।
ওবিসি শংসাপত্র সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বহু যুবক যুবতীকে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে, উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ করে দিয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের রায় এই সমস্ত যুবক-যুবতী ও পরবর্তী প্রজন্মকে জীবন জীবিকার প্রশ্নে এক অনাবশ্যক আশঙ্কার দিকে ঠেলে দিল। সামাজিকভাবে অধিকারহীন এক বিশাল সংখ্যক জনসাধারণকে আরও বেশি অধিকারহীন করে তুলল। কলকাতা হাইকোর্টের ওবিসি শংসাপত্র খারিজ করার এই রাজনৈতিক অভিসন্ধি মূলক রায়ের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এখন আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করছে।
২০১০ এবং ২০১২ এর পর যেসব জনগোষ্ঠী ওবিসি তালিকাভুক্ত হয়েছে, সঠিক পদ্ধতি মেনে তা হয়নি এই অজুহাতে ২০১০ সালের পর তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীর যেসব ব্যক্তি শংসাপত্র পেয়েছে, তাদেরই শংসাপত্র অবৈধ বলে বাতিল করা হয়েছে। বাতিলের তালিকার প্রায় সবাই মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। ওবিসি শংসাপত্র বাতিলের রায়ের ফলে সমস্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ। শিক্ষকের অভাবে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধুঁকছে। ফলে জট না কাটলে সর্বক্ষেত্রে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সব ধরনের নাগরিক পরিষেবা ভয়ংকর ভাবে বিপর্যস্ত হবে। ফলত আন্দোলন সংঘটিত হচ্ছে।
কেন আন্দোলন করতে হবে, আর এই আন্দোলনের ভাষায় বা কেমন হবে, তাও তারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া নাগরিক কনভেনশন, আলোচনার মাধ্যমে সামনে এনেছেন। এই অবস্থায় ওবিসি সংরক্ষণ অধিকার আন্দোলনকে নাগরিকদের পক্ষ থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে, সকল গণসংগঠন, সামাজিক সংগঠন, সংস্থা জোট বদ্ধ হয়ে একটি মঞ্চ গঠনের প্রয়োজন। সে কাজ যথারীতি মুর্শিদাবাদবাসী করে ফেলেছেন। জেলায় জোট বন্ধ আন্দোলন করতেই মঞ্চের নামকরণ করেছে, ‘ওবিসি সংরক্ষণ অধিকার রক্ষা মঞ্চ।’ জেলায় এই মঞ্চ তৈরি হয়েছে ১৫ টি সংগঠনকে সাথে নিয়ে।অন্যদিকে কলকাতায় ১৪ টি সংগঠন যৌথভাবে জয়েন্ট ফোরাম ফর মাইনোরিটি অর্গানাইজেশনস তৈরি হয়েছে। কলকাতাতেই আরও ৬ টি সংগঠন মিলিতভাবে তৈরি হয়েছে ওবিসি রাইট প্রটেকশন ফোরাম।
গণসংগঠন গুলি চাইছে শুধু রাজ্য বা জেলার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে প্রতিটি ব্লকে কনভেনশন করে কমিটি গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলতে। জেলায় জেলায় মিছিল করে ডিএম এবং প্রয়োজনে ডিস্ট্রিক্ট জাজকে হাইকোর্টের ওবিসি শংসাপত্র সংক্রান্ত ক্ষতিকারক রায়ের বিরুদ্ধে স্মারকলিপি দিতে হবে। ওবিসি সংরক্ষণ অধিকার রক্ষা মঞ্চ চাইছে, বিভিন্ন এলাকায় পোস্টারিং, লিফলেট বিলি, বিভিন্ন ধরনের সভা, অবস্থান, মিছিল সবই করা হবে। প্রত্যেকটা বিডিও কে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত দুটো সংগঠনই এখনও তাদের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। তবে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেতর ভেতর।
এরপরও রাজ্য সরকার কোন ভূমিকা না রাখলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করতে হবে। এই সব নেতারা চাইছে, যৌথ সংগঠনের এই আন্দোলনের মঞ্চটি সম্পূর্ণভাবে সচেতন নাগরিকদের দ্বারাই গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হবে। কোন রাজনৈতিক সংগঠনের ফ্রন্টাল সংগঠন হিসাবে পরিগণিত হবে না। মজার বিষয় হলো রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দল, তাদের শাখা সংগঠন, কেউই আন্দোলন দূরের কথা, এখনো কোনো বিবৃতিই দেননি। ফলে ওবিসি শংসাপত্র বাতিল বা আন্দোলন নিয়ে কতটা আন্তরিক তা বোঝাই যাচ্ছে। ওবিসির বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছে, তাদের ইচ্ছা যারা শংসাপত্র থাকার সুবিধার্থে চাকরি পেয়েছেন, তাদের চাকরি কিভাবে শেষ করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। এই কারণেই সংগঠনগুলো চাইছে, যারা শংসাপত্র থাকার সুবাদে চাকরি পেয়েছেন বা পড়াশোনায় বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন, তারাও জোটবদ্ধ হোক, আন্দোলনে নেমে আসুক।
যৌথ সংগঠন গুলোর গড়ে তোলা মঞ্চের অন্যতম দাবী হল-- ওবিসি সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের ক্ষতিকর রায় বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। অবিলম্বে রাজ্য সরকারকে উচ্চ আদালতে বাতিল ঘোষিত ওবিসি শংসাপত্রকে বৈধতা প্রদানের যাবতীয় আইনি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাতিল হয়ে যাওয়া সমস্ত ওবিসি শংসাপত্র অবিলম্বে চালু রাখতে হবে। কলকাতা হাইকোর্টের ক্ষতিকর রায়ের প্রভাবে কোন ছাত্রেরই ভর্তি, উচ্চশিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে ওবিসি শংসাপত্র সংক্রান্ত সমস্যার কারণে এই রাজ্যসহ অন্য কোন রাজ্যে খারিজ করা যাবে না।
এখন দেখার নানা সংগঠন গুলো নিয়ে গড়ে তোলা মঞ্চ, ফোরাম, কতদিন স্থায়ী হয় ও আন্দোলনে সক্রিয় থাকে। নাকি পাকে চক্রান্তে পড়ে অন্য সংগঠনের সঙ্গে মিশে যাবে। অন্যদিকে সরকার পক্ষের কিছু নেতৃত্ব বা সংগঠন এই মঞ্চগুলো যেন সঠিক ভাবে কাজ করতে না পারে, সে উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct