এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের ভিড়ে ঠাসা ২১ জুলাইয়ের মহাসমাবেশের সভামঞ্চ থেকে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত আগামী দিনে দলের রূপরেখা এবং সীমারেখা ঘোষণা করে দিলেন ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বার্তা দেন ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তা নজর থাকে সকল তৃণমূল নেতৃত্বদের ৷ এবছর বাড়তি আকর্ষণ ছিল লোকসভা ভোটের পর তৃণমূলের প্রথম সভা, লোকসভা ভোটে বাংলায় এ বার ২৯টি আসন নিজেদের দখলে রাখলেও দলের পক্ষ থেকে বিজয়ী উৎসব পালন করেনি তৃণমূল ৷
মমতার ঘোষণা ছিল একুশে জুলাইয়ের দিনই লোকসভা ভোটের জয় উদ্যাপন করা হবে ৷ তাই অন্যান্য বারের তুলনায় এবার ধর্মতলা চত্বরে তৃণমূল নেতা কর্মীর সমর্থকদের ভিড় ছিল নজর কাড়া ৷ এ দিন বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তব্য চালিয়ে যান ৷ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এবং আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একাধিক বিষয় স্পষ্ট করে দেন ৷ কেন্দ্রীয় এজেন্সির অতি সক্রিয়তার পরও রাজ্যের মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে থেকেছেন বলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, মমতা সরকারের আমলে রাজ্যের দরিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যাও কমেছে বলে জানান তিনি ৷ মমতা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন দলে বিত্তবানদের চাইনা বিবেকবান লোক চাই, শুধু একথাতেই থেমে থাকেননি তিনি, মমতা তৃণমূলের সকল বিধায়ক, কাউন্সিলর, সাংসদ, নেতা-নেত্রীর উদ্দেশে আরো বলেন কারও বিরুদ্ধে দল কোনও অভিযোগ পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব ৷ মমতা চান নেতারা গরিব থাকুক। ঘরে যা আছে, সেটা খেয়ে বেঁচে থাকুন। যেন লোভ না করে ৷ অন্যায় করলে কাউকে ছাড়া হবে না বলেও হুশিয়ারি দেন ৷ নেতৃত্বদের উদ্দেশ্যে মমতা গাড়ির পরিবর্তে পায়ে হেঁটে ঘোরার পরামর্শ দেন পাশাপাশি যে সমস্ত এলাকায় তৃণমূল পরাজিত হয়েছে সেই সমস্ত এলাকার মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেন ৷ মমতা কথায় বাংলাই দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করবে। বাংলার ওবিসিদের উদ্দেশ্যে মমতা আশ্বস্ত করেন, ওবিসি উঠবে না। আমরা আইনি লড়াই করছি, করে যাব।
এ দিন সমাবেশ উপস্থিত ছিলেন সমাজবাদী পার্টির সভাপতি উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব ৷ অখিলেশ বাবু এদিন কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনায় সরব হন, কেন্দ্রীয় সরকার বেশিদিন টিকবে না বলেও দাবি করেন ৷ সেই সুরে সুর মেলান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ৷ সভার শেষে পর্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গেও মুখ খোলেন ৷ মমতা বলেন, যারই রক্ত ঝরুক, তাদের সঙ্গে আমাদের সহমর্মিতা আছে্ আমরাও খবর রাখছি্ ছাত্রছাত্রীদের তাজা প্রাণ চলে যাচ্ছে। আমার কিছু বলার নেই্ একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দলীয় নেতৃত্বেদের প্রতি কড়া মেজাজে হুঁশিয়ারি দিতে দেখা যায়, তাঁর স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, পঞ্চায়েত, পুরসভার যেসব নেতা-নেত্রীদের জন্য লোকসভায় যেসব অঞ্চলে দলের ফল আশানুরূপ হয়নি, যাঁরা মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে দল তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, একমাস ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা করেছি। আগামী তিন মাসের মধ্যে এর ফল আপনারা দেখতে পাবেন। সে যত বড় নেতার ছত্রছায়ায় আপনি থাকুন না কেন, দল ব্যবস্থা নেবেই।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একুশে জুলাইয়ের সভামঞ্চে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখমন্ত্রী অখিলেশ যাদব যে বক্তব্য রাখেন তাতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে নিশানা করেন। সমাজবাদী পাটি সুপ্রিমো বলেন, এই অস্থায়ী সরকার থাকতে পারে না। রায় এই সরকারের পক্ষে নয়।
অখিলেশ যাদব এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভুয়সী প্রশংসা করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে জননেত্রী বলেও সম্মোধন করেনন ৷ অখিলেশের দলের সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, এই মুহূর্তে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল সমাজবাদী পার্টি্ ওদের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক্ অখিলেশ উত্তরপ্রদেশে দুর্দান্ত ফল করেছে ্ আমার সমর্থন সবসময় ওর সঙ্গে থাকবে্ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আগামী দিনে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে অখিলেশ যাদবের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলবেন বলেও কথা দেন।
রাজ্যে ভোটের আগে কেন্দ্রীয় এজেন্সির অতি সক্রিয়তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন ‘‘নির্বাচন কমিশনের একতরফা আচরণের পরেও লোকসভা নির্বাচনে, বিধানসভা উপনির্বাচনে মানুষ আমাদের পাশে থেকেছেন। এজেন্সির ধমকানি-চমকানির পরেও বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতে এসেছি, তাতে স্যালুট জানাই বাংলার মানুষকে। যাঁরা আমাদের সমর্থন দেননি, আগামী দিন তাঁদের কাছে সমর্থন আশা করব। সাধারণ মানুষ ছাড়া তৃণমূল পথ চলতে পারে না। আমরা যত জিতব, আমাদের তত নরম হতে হবে। যত জিতব, তত আমাদের দায়িত্ব বাড়বে। উত্তরবঙ্গে আমাদের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, আশা করব ভবিষ্যতে তারা আমাদের সমর্থন করবে্’’
অন্যদিকে আগামী দিন দলে কারা নেতৃত্ব দেবে সে প্রসঙ্গে মমতা সাফ জানিয়ে দেন ‘‘আমি দলে বিত্তবান লোক চাই না। বিবেকবান লোক চাই। কেন জানেন? পয়সা আসে, চলে যায়। কিন্তু সেবার কোনও বিকল্প নেই্’’ মমতা তৃণমূলের সকল বিধায়ক, কাউন্সিলর, সাংসদ, নেতা-নেত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘‘যেন কারও বিরুদ্ধে দল কোনও অভিযোগ না পায়। অভিযোগ পেলে দল উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব। আমি চাই আপনারা গরিব থাকুন। তার মানে ঘরে যা আছে, সেটা খেয়ে বেঁচে থাকুন। লোভ করার দরকার নেই।’’ অন্যায় করলে কাউকে ছাড়া হবে না বলেও জানান তিনি ৷ দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘অন্যায় করলে আমি দলের কাউকে ছাড়ি না। গ্রেফতার করি। অন্যায় করবেন না, অন্যায় সহ্য করবেন না। আমি পরিষ্কার বলছি, মা-বোনেদের সম্মান দেবেন্’’ মমতা বলেন, ‘‘তৃণমূল করতে গেলে সকলকে নিয়ে চলতে হবে। যেখানে যেখানে জিতেছেন, সেখানে সেখানে গিয়ে মানুষকে ধন্যবাদ জানাবেন। মানুষের জন্য কাজ করবেন। যেখানে যেখানে আমরা জিতিনি, সেখানকার মানুষের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবেন। মনে রাখবেন গাড়িতে ঘোরার চেয়ে পায়ে হেঁটে ঘোরা ভাল। তাতে শরীর-মন ভাল থাকে। বড় গাড়িতে ঘোরার থেকে স্কুটার, সাইকেলে ঘোরা ভাল্’’ বক্তব্য শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যদি পড়াশোনার সূত্রে কেউ গিয়ে থাকেন, কেউ যদি চিকিৎসার জন্য গিয়ে আটকে পড়েন, কোনও রকমের সহযোগিতার দরকার হলে আমরা পাশে আছি।’’ তার পরই তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলব না, ওটা আলাদা দেশ। যা বলবে, ভারত সরকার বলবে। আমি এটুকু বলতে পারি, যদি অসহায় মানুষ বাংলার দরজায় খটখট করে তবে আমরা আশ্রয় নিশ্চয়ই দেব। রাষ্ট্রপুঞ্জের একটা নির্দেশ আছে, কেউ যদি শরণার্থী হন, তবে তার পাশের এলাকা সম্মান জানাবে। বাংলাদেশ নিয়ে আমরা যেন কোনও প্ররোচনায় পা না-দিই, আমরা যেন উত্তেজনায় না-জড়াই। যারই রক্ত ঝরুক, তাদের সঙ্গে আমাদের সহমর্মিতা আছে। আমরাও খবর রাখছি। ছাত্রছাত্রীদের তাজা প্রাণ চলে যাচ্ছে। আমার কিছু বলার নেই্’’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct