আপনজন ডেস্ক: সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে হিন্দু দেবতা শিবের ভক্তদের বার্ষিক তীর্থযাত্রা কানওয়ার যাত্রা। যাত্রার অংশ হিসাবে, ভক্তরা গঙ্গা থেকে জল নিয়ে আসেন এবং খালি পায়ে হেঁটে বিভিন্ন শিব মন্দিরে নিয়ে যান। উত্তররাখণ্ডের কানওয়ারে তীর্থযাত্রীদের যেতে গেলে অতিক্রম করতে হয় উত্তরপ্রদেশে মুজাফফরনগর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। কানওয়ার যাত্রীদের যাত্রাপথে রাস্তার দারে সারি দিয়ে থাকে খাবারের বা ফলের দোকান। তারা তীর্থযাত্রীদের কাছে খাবার ও ফল বিক্রি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেক্ষেত্রে এতদিন এই দোকানদাররা কে মুসলিম কে হিন্দু এসবের বালাই ছিল না। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথের সরকার বৃহস্পতিবার বিশেষ নির্দেশ জারি করেছে দোকান মালিকের নাম উল্লেখ করার জন্য। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘উত্তরপ্রদেশের কানওয়ার রুটের খাবারের দোকানগুলিতে ‘নেমপ্লেট’ লাগাতে হবে। শুধু তাই নয়, কোনও হিন্দু দোকানে কোনও মুসলিম কর্মচারীও রাখা যাবে না এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে। প্রথমে দোকানদারদের দোকানের সামনে দোকানের মালিকদের নাম লেখার ফরমান জারি করা হয়েছিল কানওয়ার তীর্থযাত্রীদের রুটজুড়ে, যা সীমাবদ্ধ ছিল শুধু মুজাফফরনগর জুড়ে। কিন্তু সেই নির্দেশ এখন সমগ্র উত্তরপ্রদেশে প্রসারিত করেছে যোগী প্রশাসন।
ফলে, প্রকারান্তরে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার হিন্দু মুসলিম বিভাজনের পথ সুগম করে তুলেছে। আর এর ফলে দোকানদারদের মধ্যে অসেন্তাষের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তারা ভয়ে কেউই মুখ খুলতে রাজি নন, বরং তারা মুখ বুঁজে সেই নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু যে মুসলিম দোকানদের মধ্যে এই অসেন্তাষ দানা বেঁধেছে তা নয়, হিন্দু দোকান মালিকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বিশেষ করে যেসব মালিক তাদের দেকান মুসলিমদের কাছে চুক্তির ভিত্তিতে ভাড়ায় দিতেন, তাদের রাস্তা বন্ধ। কারণ, দোকান মালিকদের নাম হিন্দু থাকলে সেই দোকানে কোনও মুসলিম কর্মচারী রাখতে পারবে না বলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের নির্দেশ। ফলে কর্মী সঙ্কটের মুখে পড়েছেন হিন্দু দোকান মালিকরা। আর মুসলিম দোকনদাররা তাদের দোকানের সামনে মালিক হিসেবে মুসলিম নাম লিখতে বাধ্য হওয়ায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের একাংশ তার ছায়া না মাড়াতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন।
উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কানওয়ার যাত্রা রুটে সাক্ষী ট্যুরিস্ট ধাবার মালিক লোকেশ ভারতীর পুত্র অজয় সিং। গত সপ্তাহে চার মুসলিম কর্মীকে বরখাস্ত করেন। সাক্ষী ট্যুরিস্ট ধাবার মূল কর্ণধার ভারতী বলেন, পুলিশের নির্দেশনার সময় সন্দেহের সৃষ্টি করেছে যে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হচ্ছে। মালিকদের নাম প্রকাশের এই নির্দেশ যদি আগে আসত, তাহলে কোনও ক্ষোভ থাকত না। ৫১ বছর বয়সি এই দোকান মালিক বলেন, প্রায় ১০ দিন আগে, কিছু পুলিশ ধাবায় এসেছিলেন এবং কানওয়ার যাত্রার সময় সমস্ত মুসলিম কর্মচারীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেন, চারজন কর্মীকে বরখাস্ত করা আমার জন্য খুবই দুঃখজনক। তাঁরা সকলেই বহু বছর ধরে এখানে কাজ করেছেন এবং বিগত বছরগুলিতে কানওয়ার যাত্রার সময় ভক্তদের সাহায্যও করেছেন। নওশাদ, মুন্সী, ওয়াকার ও সাফাকাত খুব ভালো আচরণ করতেন। এদের মধ্যে তিনজন উত্তরপ্রদেশের খাতৌলির, একজন বিহারের। ২০১২ সাল থেকে ধাবা চালাচ্ছেন ভারতী। তিনি বলেন যে সেখানকার বেশিরভাগ ধাবা চুক্তিতে পরিচালিত হয় এবং বেশিরভাগ ঠিকাদার মুসলমান। তিনি বলেন, এখানে হিন্দু ও মুসলমান একসঙ্গে কাজ করছে। কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। পুলিশের এই নির্দেশ হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করবে। আপাতত কর্মীর ঘাটতি মেটাতে নতুন হিন্দু কর্মী নিয়োগ করেছেন ভারতী, তবে যাত্রা শেষ হলেই বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের ফের নিয়োগ করবেন বলে দাবি করেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এই মানুষগুলো ২০-২৫ দিন ঘরে বসে থাকবে। তাঁদের জীবিকা এই চাকরির উপর নির্ভরশীল বলে তিনি জানান।
পুলিশের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, মুজফফরনগরের মুসলিম মালিকরা তা মেনে চলেছেন তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে। খালাপাড় বাজারে রাস্তার পাশের দোকানের শিরমল বিক্রেতা মোহাম্মদ হাসান বলেন, এই প্রথম লোকজনকে তাদের দোকান চিহ্নিত করার জন্য তাদের নাম প্রদর্শন করতে বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, হিন্দু ও মুসলমান একে অপরের দোকান থেকে পণ্য কেনে। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। কিন্তু এই সরকারি নির্দেশের একটাই উদ্দেশ্য, ভাইকে ভাই থেকে আলাদা করা। তার প্রশ্ন, নেমপ্লেট লাগানোর পরও গ্রাহক এলে ঠেকাবেন কীভাবে? আমরা প্রশাসনের নির্দেশের বিরোধিতা করিনি। তারা যেভাবে বলেছে আমরা সেভাবেই করেছি বলে জানান হাসান।
খালাপাড় বাজারের কয়েক ডজন দোকানদার তাদের দোকানে নে প্লেট লাগিয়েছেন। এমনকি ফল বিক্রেতারাও তাদের ঠেলাগাড়ি এবং স্টলগুলিতে তাদের নাম লিখিয়েছেন। আম বিক্রেতা আরিফ তার ঠেলাগাড়ির পাশে একটি সাদা বোর্ড লাগানো দাঁড়িয়ে আছেন, যাতে হিন্দিতে লেখা ‘আরিফ ফল’। কয়েকদিন আগে পুলিশ এসে আমাদের ঠেলাগাড়িতে আমাদের নাম লিখতে বলে, জানান আরিফ। আরিফ প্রায় ১০ বছর ধরে ফল বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, এমন কথা আগে কখনো বলা হয়নি। আমাদের বলা হয়েছে কানওয়ার যাত্রার নেমপ্লেট লাগিয়ে যাত্রার পর সেগুলো সরিয়ে দিতে। ২২ জুলাই থেকে কানওয়ার যাত্রা শুরু হতে চলেছে এবং মুজফফরনগরের আমিষ খাবার বিক্রির রেস্তোরাঁগুলি বন্ধ হতে শুরু করেছে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘উত্তরপ্রদেশের কানওয়ার রুটের খাবারের দোকানগুলিতে ‘নেমপ্লেট’ লাগাতে হবে। কানওয়ার তীর্থযাত্রীদের বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যারা হালাল সনদ নিয়ে পণ্য বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুসলিম দোকানদারদের দাবি, পুলিশ প্রশাসন তাদের নাম প্রদর্শনের জন্য চাপ দিয়েছিল।
কয়েক দশক ধরে কানওয়ার যাত্রার পথে চায়ের দোকান চালানো শাহিদ বলেন, দোকানে ইতিমধ্যেই আমার বাবার নামে একটি বোর্ড রয়েছে, কিন্তু প্রশাসন আমাদের নতুন বোর্ড লাগাতে বলেছে। সরকার যেভাবে চায় আমরা সেভাবেই নিজেদের তুলে ধরছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতি বছর কানওয়ারিয়াদের সেবা করি। তারা আমাদের দোকানে থামে এবং আমাকে শহীদ ভাই বলে ডাকে। আমরা কখনো তাদের প্রতি বৈষম্য করিনি।
ফলের গাড়িতেও নাম লেখা হয়েছে। কেউ ফল বানাচ্ছে না, গাছ থেকে ফল আসে। কিন্তু মুসলিমরা তাদের গায়েও নাম লিখতে বাধ্য হচ্ছে,” শাহিদ মন্তব্য করেন, “ভুল” হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। মুজফফরনগরের উদাহরণ অনুসরণ করে উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারের পুলিশও একই পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে।
সিনিয়র পুলিশ সুপার প্রমোদ দোভাল শুক্রবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কানওয়ার যাত্রার পথে সমস্ত দোকান, রেস্তোরাঁ, ধাবা এবং হকারদের মালিকের নাম এবং কিউআর কোড যাচাই করে তা লেখার জন্য হরিদ্বার পুলিশ জোর দিচ্ছে। কেউ তা না মানলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বহুজন সমাজ পার্টির প্রধান মায়াবতী এক্স-এ একটি পোস্টে এই নির্দেশকে “অসাংবিধানিক” বলে অভিহিত করেছেন। একটি বিশেষ ধর্মের মানুষকে এভাবে অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করার চেষ্টা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
মুজফফরনগরের সমাজবাদী পার্টির সাংসদ হরেন্দ্র মালিক বলেন, “প্রশাসন হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন ঘটাতে চায়। অতীতে কখনও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এবারই প্রথম এমন ঘটনা ঘটছে।
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এক্স-কে পোস্ট করেছেন, “এখন প্রতিটি খাবারের দোকান বা ঠেলাগাড়ির মালিককে বোর্ডে নিজের নাম রাখতে হবে, যাতে কোনও কানওয়ারিয়া ভুল করে কোনও মুসলিম দোকান থেকে কিছু না কেনেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় একে বলা হতো বর্ণবাদ, আর হিটলারের জার্মানিতে বলা হতো জুডেনবয়কট।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct