নিজস্ব প্রতিবেদক, কলকাতা, আপনজন: নিখাত ইসলামি শিক্ষাদানের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল খারিজি বা কুরআনিয়া মাদ্রাসাগুলি। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় হাজার তিনেক এই ধরনের বেসরকারি মাদ্রাসা থাকলেও তার বেশিরভাগটাই উত্তরপ্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসারী। আর পশ্চিমবাংলায় দেওবন্দ ঘরানার এই সব দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বেশিরভাগই সংগঠিতভাবে পরিচালিত হয় পশ্চিমবঙ্গ রাবেতায়ে মাদারিসে ইসলামিয়া আরাবিয়া বা মাদ্রাসা সমন্বয় সমিতির মাধ্যমে। এই সংগঠনটি দেওবন্দের রাবেতায়ে মাদারিসে ইসলামিয়া আরাবিয়ার অনুমোদনপ্রাপ্ত। এই সকল দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে মূলত হাফিজ, মাওলানা, মুফতি, ক্বারী প্রভৃতি ইসলামি বিদ্বান তৈরির পাঠ দেওয়া হয়। ইসলামি মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে চলে এই সকল মাদ্রাসাগুলিতে এখন পাঠ্যক্রমের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সেই পাঠক্রমে আরবি, উর্দু, ফার্সি পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ভূগোল যুক্ত হয়েছে। এমনকি রয়েছে কম্পিউটার শিক্ষার পাঠও। তবে, আরবি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক বিষয়ে শিক্ষাদানেও বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বুধবার কলকাতার বাঁকড়ায় পশ্চিমবঙ্গ রাবেতায়ে মাদারিসে ইসলামিয়া আরাবিয়ার সদর দফতরের মাওলানা আসাদ মাদানি রহ, অডিটোরিয়ামে কার্যনির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন হয়। সেই অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গ রাবেতায়ে মাদারিসে ইসলামিয়া আরাবিয়ার সভাপতি তথা রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি কড়া হুঁশিয়ারি দেন এই সংগঠনের আওতাধীন মাদ্রাসাগুলিতে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বা ভূগোল বিসয়ে পঠনপাঠনে কোনও দরেনর গাফিলতি দেখা গেলে সেই মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ রাবেতায়ে মাদারিসে ইসলামিয়া আরাবিয়ার আওতাধীন হাজারটিরও বেশি খারিজি মাদ্রাসা রয়েছে। দারুল উলুম দেওবন্দের রাবেতার নির্দেশ মেনে এই সংগঠন সিলেবাস সহ পঠনপাঠন রীতি নির্ধারণ করে থাকে। এদিনের অধিবেশনে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি বলেন, স্বাধীনতার পর দরসে নিজামী মাদ্রাসার সর্বভারতীয় এই বোর্ড বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে রাবেতা বোর্ড দক্ষতার সঙ্গে ২৫ বছর ধরে সুনাম, সুখ্যাতি ও দায়িত্বের সঙ্গে কার্যপরিচালনা করে দারুল উলুম দেওবন্দের চোখে ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রায় ৩০-৪০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নিয়ে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কোনও মাদ্রাসা ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর থাকলে সেই সম্পত্তি সোসাইটি বা ট্রাস্টের নামে নিবন্ধিকরণ করতে হবে। মাদ্রাসার দলিল দস্তাবেজ যথাযথভাবে রয়েছে কি না তা নিরূপণ করতে হবে যাতে কেউ তঞ্চকতা করতে না পারে। মাদ্রাসার পঠন-পাঠন সঠিকভাবে হচ্ছে কি না নিপুণতার সঙ্গে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বোর্ড এবিষয়ে প্রতিটি মাদ্রাসাকে যে সমীক্ষাপত্র দেয় তা নিয়মমত পাঠানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ছাত্রদের পড়াশুনায় অবহেলা করলে তাদেরকে প্রহার করা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। পরিবর্তে সৃজনশীলভাবে শিশু মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাবেতার গৃহীত সিদ্ধান্তে আরও বলা হয়েছে, মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া প্রতিটি ছাত্রের জন্য তার ও তার অভিভাবকের সচিত্র পরিচয়পত্র ও জন্ম শংসাপত্র বাধ্যতামূলক যার প্রতিলিপি তার ভর্তি খাতায় হেফাজতে থাকবে। পরিচয়পত্রহীন কোনো ছাত্র যাতে মাদ্রাসায় না থাকে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। রাবেতা বোর্ড পরিবেশিত পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যক্রম বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হবে। মাদ্রাসার ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যাতে দূষণ না ছড়ায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
তবে, বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে নির্ধারিত দ্বীনি শিক্ষার পামাপাশি অতিরিক্তি বিষয় হিসেবে অধুনিক বিষয়ে পঠনপাঠনের উপরে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, ভূগোল পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিবেচনা করে কোনো শৈথিল্য বা গাফিলতি করলে রাবেতা বোর্ড কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে মাদ্রাসাগুলিকে। সেই সঙ্গে একজন হাফিজ বা মাওলানা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেসব সব মাদ্রাসাা কমপক্ষে মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করতে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ দেওয়া হয় সেখানে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিনের অধিবেশনে জানিয়ে দেওয়া হয়, আগামী শাবান মাসের (১৪৪৬ হিজরি) প্রথম সপ্তাহে রাবেতা বোর্ডের বাৎসরিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এবছর জেলায় জেলায় বা ২-৩টি জেলা একত্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণ (তাদরীবুল মুয়াল্লিমীন) শিবিরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষকদের মতো পরীক্ষার খাতা দেখার দক্ষতা অর্জন করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
তবে, খারিজি মাদ্রাসাগুলি থেকে পড়াশুনা করে যোতে ছাত্ররা আদর্শ মানুষ হতে পারে তার উপর বিশেষ নজর দেওয়ার আর্জি জানান মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি। এ ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, ভারতের সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত ধর্মীয় শিক্ষার স্বাধীনতা রক্ষার্থ মাদ্রাসাগুলি বদ্ধপরিকর। মাদ্রাসাগুলি সৎ, আদর্শবান, দেশপ্রেমিক সুনাগরিক গড়ে তোলার সূতিকাগার।
পশ্চিমবঙ্গ রাবেতায়ে মাদারিসে ইসলামিয়া আরাবিয়ার এদিনের অধিবেশনে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক মনজুর আলম, রাজ্য রাবেতা বোর্ডের সম্পাদক মুফতি আব্দুস সালাম সাহেব, সাধারণ সম্পাদক মুফতি ফখরুদ্দীন সাহেব, মুফতি মিসবাহুল ইসলাম, মাওলানা বদরুল আলম, মাওলানা ইমতিয়াজ আলী, মাওলানা আনিসুর রহমান, জেড আর আরিফ, মুফতি ইমদাদুল ইসলাম, হাফিজ আকিল আহমেদ প্রমুখ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct