প্রিন্স বিশ্বাস, আপনজন: আগের দিনে দাপুটে লোকেরা পালকিতে চড়ত। সাধারণ মানুষ ছিল অত্যন্ত গরিব এবং দূরের যাত্রা করতে পায়ে হেঁটে চলত। কিন্তু জমিদার বা রাজা-মহারাজাদের জন্য পালকি ছিল অন্যতম প্রধান বাহন। যদিও ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়িও ছিল, পালকি ছিল ধনীদের আভিজাত্যের প্রতীক।
একশ বছর আগেও দেশে মোটরগাড়ি ছিল না, রেলগাড়ির প্রচলন কেবল শুরু হয়েছিল। রেলগাড়ির আগের সময়ে মানুষ গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি এবং পালকির ওপর নির্ভর করত। পরিবারের লোকেরা ছোটখাটো দূরত্বে চলাচলের জন্য পালকি ব্যবহার করত। পালকির ব্যবহার ঠিক কত আগে শুরু হয় তা নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। মিসরীয় ও মায়া সভ্যতার চিত্রলিপিতে পালকির ছবি পাওয়া গেছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে লেখা বাল্মিকীর রামায়ণেও পালকির কথা বহুবার এসেছে। পুরাণকাহিনিতে পালকির ব্যবহার শুধু ঠাকুর-দেবতাদের জন্য উল্লেখ আছে।
আদিম যুগের মানুষ পশু শিকার করে খাদ্যের চাহিদা মেটাত। তারা শিকার করা মৃত পশু বড় একটা লাঠির মাঝখানে ঝুলিয়ে বয়ে নিয়ে আসত বাড়িতে। শিকার বহনের এই পদ্ধতিই পরে পালকির ধারণা তৈরি করে বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক। মোগল আমলে রাজপরিবারের নারীদের মধ্যে পালকি বেশ জনপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। মোগল রমণীরাও সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে যেতেন পালকি চড়ে। সম্রাট হুমায়ুন সিংহাসনে বসার কিছুদিন পরেই ক্ষমতাচ্যুত হন বাংলার শাসক শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে। এরপর বহুদিন তিনি ফেরারি ছিলেন এবং অল্প কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন গুজরাট-মহারাষ্ট্রের পথে-প্রান্তরে। হুমায়ুনের স্ত্রী তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতেন পালকিতে চড়ে। গুজরাটের মরুপ্রান্তরে পালকিতে ঘুরতে ঘুরতে জন্ম নেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সম্রাট আকবর।
সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পালকি একটি বিশেষ মর্যাদা পেয়ে এসেছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘পালকির গান’ ছড়ায় তুলে ধরেছেন গাঁয়ের পথে চলা পালকির এক অবিস্মরণীয় চিত্র— “পালকি চলে!/ পালকি চলে!/ গগন তলে/ আগুন জ্বলে!/ স্তব্ধ গাঁয়ে/ আদুল গায়ে/ যাচ্ছে কারা/ রোদ্র সারা...”। পরে এই ছড়াটি কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গান হিসেবেও খ্যাতি লাভ করে। পালকি নিয়ে গান গেয়েছেন ভূপেন হাজারিকাও। তাঁর ‘দোলা হে দোলা’ গানটিতে তিনি পালকির বেহারাদের দুঃখভরা জীবনসংগ্রামের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
যাঁরা পালকি বহন করতেন তাঁদের বলা হতো বেহারা বা কাহার। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসটিতে হতদরিদ্র কাহার সমাজের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সেই ছোট্ট ছেলেটির মা-ও পালকিতে চলছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পালকিতে চড়ে ঘোরাঘুরি করতেন। শিলাইদহের জমিদার থাকার সময় প্রজাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তিনি পালকি ব্যবহার করতেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের রবীন্দ্রকুঠিতে আজও তাঁর ব্যবহার করা বেশ কিছু পালকি রাখা আছে। কুষ্টিয়ারই আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনও পালকিতে চড়তেন। বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের জন্য খ্যাত এই লেখকের ব্যবহৃত একটি পালকি তাঁর লাহিনীপাড়ার বাড়িতে রাখা আছে।
পালকি আসলে কাঠ দিয়ে তৈরি ছোট্ট বাহন। সাধারণত পালকিতে একজনই চড়তে পারতেন, তবে বড় পালকিতে একাধিক মানুষের বসার ব্যবস্থাও ছিল। পালকির আকার-আকৃতি ছিল নানা রকম। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পালকির প্রচলন ছিল। দেশের সামাজিক রীতিনীতির ওপর নির্ভর করত পালকি দেখতে কেমন হবে। কোথাও একেবারে বদ্ধ-গুমোট পালকির চল ছিল, কোথাওবা ছাদখোলা পালকি। আমাদের উপমহাদেশের পালকির চেহারা ছিল চারকোনা সিন্দুকের মতো। দুপাশে দুটো দরজা—কাপড়ের পর্দা দিয়ে ঢাকা দরজা। কিছু পালকির চেহারা সিংহাসনের মতো। ওপরের দিক খোলা আরামদায়ক এক চেয়ার যেন। ব্রিটেনের অভিজাত লোকেরা যেসব পালকিতে চড়তেন, সেগুলোতে শোবার ব্যবস্থাও ছিল।
পালকির সামনে ও পেছনে এক বা একাধিক লম্বা হাতল থাকত। সেই হাতল কাঁধে রেখে বেহারা পালকি বয়ে নিয়ে চলতেন। পালকির আকারের ওপর নির্ভর করে পালকির ভার বইতেন দুই, চার, ছয়, আট এমনকি ষোলো জন বেহারা। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে, ভীষণ কষ্ট সয়ে বেহারারা পালকি বয়ে নিয়ে যেতেন মাইলের পর মাইল। কষ্ট ভুলতেই তাঁরা একটি ছন্দ আওড়াতেন—“হুনহুনা, হুনহুনা।”
পৃথিবী বদলে গেছে, রাজাদের রাজত্ব গেছে, জমিদারের জমিদারিও গেছে। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, রিকশা ইত্যাদি নানা রকম যানবাহন এসেছে। এসব যানবাহনে ধনী-গরিব সবাই চলাচল করতে পারে। বিয়েতেও আজকাল নানা রকম বাহারি গাড়ি ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসের দায় মিটিয়ে তাই হারিয়ে গেছে পালকি। শেষ হয়েছে কাহারদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কষ্টের জীবন। পালকির স্থান এখন ইতিহাসের পাতায়, সিনেমার পর্দায় এবং জাদুঘরের শোকেসে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct