ইসলাম চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, মর্যাদা, গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে তোলার অভিপ্রায়ে এই উপস্থাপনা। সভ্যতার আলোকবর্তিকাটি ইসলাম-ই মধ্যযুগ থেকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানের অন্তহীন বিকাশে মদদ করেছে। বিভিন্ন সুফি-সাধক ইসলামের মর্মবাণীকে আরও বিকশিত করেছে। অত্যুজ্জ্বল এই মহত্তম বিষয়টির উপর আলোকপাত করেছেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি অন্বেষক-ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ।
শেইখ আবদুল কাদির জিলানির নাম নিখিল বিশ্বের ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লিখিত হয়ে আছে। প্রাচ্য বা প্রতীচ্যের এমন কোন বিদগ্ধজন নেই যাঁরা কিনা শেইখ আবদুল কাদির জিলানির গুণমুগ্ধ নন। ৪৭০ হিজরিতে প্রায় ‘ইনসান-উল-কামিল’ (পূর্ণ মানব) জিলানির জন্ম হয়েছিল। জিলান নামক একটি অঞ্চলে তাঁর জন্ম হয়েছিল। সেই সুবাদে তাঁর মূল নামের শেষে জিলানি শব্দ পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই অভিজাত অঞ্চলটির ভৌগলিক অবস্থান ছিল পারস্যের অন্তর্গত একটি অংশে। তাঁর উদারতা, মহানুভবতা এবং সত্যের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধ সম্পর্কে ইসলামাশ্রয়ী বুজুর্গবর্গ সম্যক ওয়াকিবহাল রয়েছেন। ইউরোপীয় পণ্ডিত সমাজ তাঁর সম্পর্কে অন্তহীন শ্রদ্ধাশীল। তাঁর দার্শনিক চিন্তা তাঁদের প্রভাবিত করেছে।
শৈশব থেকেই অনুধাবন করা গেছিল যে শিশুটি ব্যতিক্রমী স্বভাবের পরিচয় রাখছেন। তাঁর মাতৃভক্তি ছিল প্রবাদ বাক্যের মতো। বয়স ১৮-পূর্ণ যুবায় রূপান্তরিত হলেন এবং তৎকালীন দুনিয়ার শিক্ষা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বাগদাদ মহানগরীতে শিক্ষার্জনের অভিপ্রায়ে পৌঁছলেন। সেখানে তাঁর মেধা ও মনন বিকাশের বিস্তীর্ণ পরিসর পেলেন। ছাত্র হিসেবে শেইখ আবুল কাদির জিলানি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী এবং অবশ্যই প্রতিভাধর। খুব অল্প এবং বাস্তবোচিত সময়ের মধ্যেই সেখানকার তাবৎ সুধিজনের স্নেহ-ভালবাসা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বহুল বিদ্বজ্জন পরিচিতির ফলে জানা-অজানা বিষয়ের প্রতি গভীরভাবে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন। এর সূত্র-সন্ধানে তাঁর নিজস্ব অর্জিত ঔজস্বিতাকেই নিয়োগ করতেন। ছাত্রজীবন শেষে প্রার্থনা, জ্ঞানচর্চা এবং আত্মজিজ্ঞাসার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সুফি-দার্শনিকের চারিত্রিক প্রকাশ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে।
প্রায় চারদশক তিনি ইসলামি চিন্তাচর্চার মধ্যে নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর কঠোর পরিশ্রমের মারফত স্বোপার্জিত জ্ঞানরাশি লিখিতভাবে নথিপত্র, কিতাব, পাণ্ডুলিপি তৈরির জন্য ৪০০ (চারশত) শিক্ষিত কলমচির প্রয়োজন পড়েছিল। এই বিষয়টি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে চিন্তা-চর্চার ক্ষেত্রে তিনি একটি বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন।
এইবারে একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এমনতরো একটি বিষয় মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবনেও ঘটেছিল। বিষয়টি খোলসা করি: তিনি বিশেষভাবে বাস্তববাদী একজন পণ্ডিত-দার্শনিক। নিজে যা পালন করতে অপারগ হতেন তা অন্য কাউকে পালন করতে উপদেশ দিতেন না। একটি বিশেষ আগ্রহউদ্দীপক ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। একবার এক বৃদ্ধা মহিলা শেইখ আবদুল কাদির জিলানির কাছে এই আবেদন করলেন যে তাঁর পুত্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত মিষ্টি খেতে আগ্রহী এবং অভ্যস্তও বটে। শেইখ আবদুল কাদির জিলানির কাছে বৃদ্ধা প্রার্থনা জানিয়েছিলেন যে তিনি যেন তাঁর পুত্রকে মিষ্টি না খাওয়ার জন্য ‘নসিহত’ করেন।
শেইখ জিলানি এই বাবদে সেদিন কিছু উচ্চবাচ্য করলেন না। বৃদ্ধাকে তিনি বললেন যে, তিনি যেন কয়েকদিন পরে এসে আবার দেখা করেন। বৃদ্ধা মর্মাহত হলেন। কেননা তাঁর পুত্রকে শোধন করার কোনও পরামর্শ তিনি পেলেন না। কিছুদিন বাদে উক্ত বৃদ্ধা পুনরায় এলেন। এইবার শেইখ আবদুল কাদির জিলানি কিশোরটির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘বাবা তুমি বেশি মিষ্টি খেয়ো না। এতে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারো।’ বৃদ্ধা-মহিলা হতচকিত হয়ে সুফি-দরবেশ শেইখ আবদুল কাদির জিলানিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহাত্মন— এই কথাটি প্রথম দিনই
তো বলতে পারতেন।’ শেইখ জিলানি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘মা আমি ওই সময়ে নিজেই মিষ্টিতে আসক্ত ছিলাম। নিজে যা পরিত্যাগ করতে অপারগ ছিলাম— তাহলে আমি আপনার পুত্রকে কিভাবে মিষ্টি খেতে নিষেধ করতাম! আমি নিজে মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছি। এবার তাকে নিষেধ করতে পারি। আমি আশা করি মহান আল্লাহ এবার আমার প্রার্থনার মূল্য দেবেন।’
অসাধারণ নির্মল চারিত্র্যের অধিকারী ধর্মপ্রাণ জিলানি কথার চেয়ে কাজের প্রতি মর্যাদা আরোপ করতেন। শেইখ জিলানির জীবন ছিল ইসলামি ভাবাদর্শের মূর্ত অভিব্যক্তি। তাঁর প্রতিটি কাজই ছিল নৈতিকাদর্শের প্রকাশ। ইসলামের মৌলিক আদর্শ এবং তাঁর মানবীয় ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে তাত্ত্বিক একটি জীবনধারা তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ইসলামি দুনিয়ার বিশাল ভূখণ্ডে শেইখ আবদুল কাদির অশেষ মান্যতা পেয়ে থাকেন। তাঁর আত্মার সঙ্গে শান্তির সহাবস্থান হোক। এক্ষণে আমরা ভিন্নতর একজন সুফি-দার্শনিক, অতীন্দ্রিয়বাদী সাধকের দু’একটি তথ্য পেশ করব। বর্তমান প্রজন্ম যেন তাঁর নামের সঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ পরিচিত হয়ে উঠতে পারে। আবুল কাশিম আল্ জুনেদ বাগদাদী একজন খ্যাতনামা পণ্ডিত। জুনেদ বাগদাদী তাঁর সমচিন্তা বা সমধারার চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ। ইসলামি চিন্তাচর্চার সঙ্গে আধ্যাত্মিক চিন্তার ব্যাপক সংশ্লেষ তিনি করেছিলেন। জুনেদ বাগদাদী। সুফিবাদের একটি ধারা ইবন মুহম্মদ আল মুহাওয়ান্দি নামে পরিচিত ছিল। গণতান্ত্রিক ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানবতাবাদের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করতেন। ঐতিহাসিক নানান প্রেক্ষাপটে মতবাদটি কিয়ৎকাল উপেক্ষিত হয়। ক্ষীয়মান হয়ে ওঠে। আবুল কাশেম আল্ জুনেদ বাগদাদী এই মতবাদটিকে উজ্জীবিত করেন। সঙ্কট মুক্ত করেন চিন্তার এই শ্রেণিটিকে (A class of thought).
জুনেদ তাঁর কিশোর বেলা থেকেই ইসলামি জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে আগ্রহী আর জিজ্ঞাসু হয়ে উঠেন। তিনি চিন্তা করতেন খুব সুশঙ্খলভাবে এবং সময়ের বিচারে অগ্রবর্তী উপাদানের প্রতিও তাঁর অনুসন্ধিৎসা ছিল চমকপ্রদ।
জুনেদ প্রায় শিশুকাল (মাত্র ৭ বছর বয়সে) থেকেই ইসলাম সম্পর্কে সম্পৃক্ত অঞ্চলগুলো তাঁর পিতৃ ও মাতৃকূলের আত্মজনদের সঙ্গে দেখে এসেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব। ধর্মীয় নির্দেশ ও আইনের প্রতি জুনেদের শ্রদ্ধাবোধ ছিল অশেষ। তিনি দাবি করেছিলেন যে সুফি-মতবাদ আল্ কুরআনের উপরেই নির্ভরশীল।
জুনেদ আরও বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন, জাগতিক জীবন পরীক্ষামূলক। আল্লাহর আদেশের প্রতি মাথা নত এবং সৎকাজ করে মানুষ মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছয়। সুফি তাত্ত্বিক দর্শন প্রচারকবর্গের মধ্যে জুনেদ একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্র।
জুনেদ বাগদাদীকে অনেকেই ‘Peacock of Learned’ বলে সম্মানিত করেন। তিনি প্রায় ৩০ বার মক্কা ভ্রমণ করেছিলেন পায়ে হেঁটে। প্রার্থনার প্রতি ছিল অতলান্তিক এক অনুরাগ। মহান আল্লাহর ৯৯ নাম তিনি উচ্চারণ করতেন প্রার্থনার সময়। ৪০ বছর ধরে তাঁর অতিন্দ্রীয়বাদ প্রচার করেন। জুনেদ বেশকিছু কিতাব রচনা করেছিলেন। বিস্ময়ের কথা এগুলো পাণ্ডুলিপি হিসেবে বাগদাদে এখনও সুরক্ষিত বলা যেতে পারে। তাঁর ‘কিতাব আল্ ফানাহ’ তাঁর দর্শন চর্চার স্মারক হিসেবে এখনও মধ্যপ্রাচ্যের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পাঠ্য হয়ে বহাল তবিয়তে টিকে রযেছে। এখনও এই সময় মতবাদ বিভিন্ন দেশের অ্যাকাডেমিক স্তরে বিশ্লেষণ হচ্ছে সেও ভারি চমকপ্রদ বিষয়। মনে রাখা দরকার, ‘Truth is ever discoverable’.
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct