পাভেল আখতার, আপনজন: একটি মানুষ এসেছে ‘তাঁর কাছে’ সাহায্য চাইতে। সোজা কথায় বললে, ‘ভিক্ষাবৃত্তি’। ‘তিনি’ খুব নরম স্বরে মানুষটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ঘরে কী আছে ?’ সে খুবই যৎসামান্য জিনিসের কথা বলল, যার মধ্যে একটি কুঠারও ছিল। ‘তিনি’ কুঠারটা ঘর থেকে নিয়ে আসতে বললেন। সে নিয়ে এল। তারপর ‘তিনি’ মানুষটিকে নিয়ে গেলেন শুকনো, মৃতপ্রায় কিছু গাছের কাছে। শুকনো ডালগুলি দেখিয়ে বললেন, ‘এগুলি জ্বালানির জন্য উপযুক্ত। কুঠার দিয়ে তুমি এসব সংগ্রহ করে বিক্রি করবে। এবং, এই জীবিকা অবলম্বন করে জীবনযাপন করবে।’ এর থেকে কী শিক্ষা পাওয়া যায় ? ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ নয়, কর্মের মাধ্যমে ‘আত্মসম্মান’ বজায় রেখে জীবনযাপন করা। কিন্তু, আরেকটি অন্তর্নিহিত বিষয় সচরাচর এখানে খেয়াল করা হয় না। সেটা হ’ল, কোনও কিছুই ফেলে দেওয়ার নয়, এবং ‘অল্প কিছু’ দিয়েও ‘অনেক কিছু’ করা যায়, সর্বোপরি হতাশার নাম জীবন নয়। রবীন্দ্রনাথও লিখছেন, ‘অল্প লইয়া থাকি তাই, মোর যাহা যায় তাহা যায়..।’ বস্তুত, ‘অল্প’ কথাটা মোটেই ‘অল্প’ নয়। ব্যবহার করতে জানলে সেটাই ‘অধিক’ হয়ে ওঠে--নিষ্ঠা, সাধনা যদি তার ‘সঙ্গী’ হয়, ফাঁক ও ফাঁকি না থাকে। এসবই কেবল অনুসরণীয় ; ‘বিক্ষিপ্ত, অচল ও অকাজের ভাবনা’ না ভেবে।
উপরে আগন্তুক ও কুঠার নিয়ে যাঁর কথা বললাম ‘তিনি’ কে ? হযরত মহম্মদ (স)। একজন আদর্শ ‘শিক্ষক’। বস্তুত, আমরা দেখি, প্রত্যেক শুক্রবারে ভিখারির ঢল নামে। যারা ভিক্ষা করছে তারা তো জানেই না, যারা ভিক্ষা দিচ্ছে তারাও কি জানে ? না। তারা তো ভিক্ষা দিচ্ছে নেকি বা পুণ্যের আশায় ! অথচ, ভিক্ষা দেওয়া মানে ভিক্ষাবৃত্তিকে উৎসাহিত করা, যা উপরে বর্ণিত মহম্মদ (স)-এর শিক্ষার পরিপন্থী হওয়ায় তা মোটেই পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাহলে করণীয় কী ?
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘উপকার করিব বলিলেই উপকার করা যায় না, উপকার করিবার অধিকার থাকা চাই।’ অর্থাৎ, যার ‘উপকার’ করা হচ্ছে, সে যেন বুঝতে না পারে যে, তাকে উপকারের নামে আসলে ‘করুণা’ বা ‘অনুগ্রহ’ করা হচ্ছে। অনেকেই ‘জীবে দয়া’র মহিমা কীর্তন করে থাকেন, কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে যে, ‘দয়া’ নামক বস্তুটিতে দান ও গ্রহণের সূত্রে উচ্চ-নীচ বা বড়-ছোট’র পঙ্কিল স্পর্শ আছে, কোনও মহিমাই সেখানে নেই। উপরন্তু ‘দয়া’ মনুষ্যত্বের অপার মহিমাকেই কলুষিত করে। এর পরিবর্তে ‘দায়’ বা ‘দায়িত্ব’ মনুষ্যত্ব ও মানবতাকে মহিমান্বিত করে। অর্থাৎ, আর্ত-অসহায় বা বিপন্ন মানুষকে সহায়তা উৎসারিত হতে হবে হৃদয়ের গভীর তলদেশে বহমান ‘দায়িত্ববোধের প্রেরণা’ থেকে, যে ‘দায়িত্ববোধ’ মনে করিয়ে দেবে যে, সম্পাদিত উপকারটির মাধ্যমে গ্রহীতাকে নয়, আসলে নিজেকেই ‘ধন্য’ বা ‘কৃতার্থ’ করা হচ্ছে। তখনই সেই দানে ‘দয়ার আবিলতা’ অপসৃত হবে। দাতা-গ্রহীতার মধ্যে তখনই সব ব্যবধান মুছে যাবে। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ ‘উপকার করিবার অধিকার’ বলতে ঠিক এই ব্যাপারটাই চমৎকারভাবে বলতে চেয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হ’ল, আমাদের সামনে প্রায়শই যেসব সাহায্যপ্রার্থী এসে হাজির হয়, তাদেরকে আমরা কি ‘দায়িত্ববোধ’ থেকে সাহায্য করি ? না কি, আমাদের তাৎক্ষণিক ও যৎসামান্য সেই দানে মিশে থাকে শুধুই অঢেল ‘দয়া’ ? প্রথম কথাই হচ্ছে, একটি মানুষ এসে আমার কাছে তার হাত দুটো প্রসারিত করছে এবং হয়তো ‘দয়া’ই ভিক্ষা করছে---এর চেয়ে চরম লজ্জার বিষয় আর কিছু হতে পারে না ! আমি নিজেই যেখানে আমার জীবন, আমার অস্তিত্বের বিষয়ে সম্পূর্ণ ‘আত্মনির্ভরশীল’ নই, আমাকেও অনেকের উপর ও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করতে হয়, এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই যখন চরম বাস্তবতা, তখন এক হিসেবে আমিও তো অভাবী ও অসহায়, অতএব করুণার পাত্র, তাহলে কিসের ‘অহংকারে’ অন্যকে ‘দয়া’ বা ‘করুণা’ করব ! কিন্তু, আমি যদি আমার ‘দায়িত্বের অনুভূতি’ সম্পর্কে সচেতন এবং তা পালনে সক্রিয় থাকতাম তাহলে তো আর ওই আগন্তুক অসহায় মানুষটি সসঙ্কোচে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ‘দয়াভিক্ষা’ করত না ! ওই মানুষটির পা দুটো ওঠার আগেই আমার পা দুটো ওঠার কথা ছিল ! কিন্তু আমি বসে রয়েছি পরম নিশ্চিন্তিতে বলেই তাকে বাধ্য হয়ে উঠতে হয়েছে ! এ ‘লজ্জা’ রাখার জায়গা নেই !
আমরা ‘মানুষের সমাজ’ নিয়ে কত-না ‘গর্ব’ করি ! একই সঙ্গে ‘লজ্জা’ ও ‘গর্ব’ কখনও সহাবস্থান করতে পারে না। ‘লজ্জার দিন’ অবসান হলেই কেবল পূর্ব দিগন্তে ‘গর্বের অরুণোদয়’ হতে পারে !
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct