যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে বিশ্ববিশ্রুত কিংবদন্তি চিকিৎসক ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের নাম, যার জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে।কি এক অদ্ভুত সমাপতন জড়িয়ে রয়েছে তাঁর সঙ্গে। এই রকমের একই দিনে জন্ম ও মৃত্যু কে বিজ্ঞান তথা মনস্তত্ত্বের ভাষায় বলা হয়’বার্থডে এফেক্ট’বা’বার্থডে ব্লু’স’। গোটা জীবনে নানান ধরনের মিথ তৈরি করেছিলেন তিনি। বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন কর্ম যোগী। একাধারে তুখোড় রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব আবার ধন্বন্তরী চিকিৎসক ও প্রশাসনিক দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার। লিখেছেন এম ওয়াহেদুর রহমান...
যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে বিশ্ববিশ্রুত কিংবদন্তি চিকিৎসক ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের নাম, যার জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে।কি এক অদ্ভুত সমাপতন জড়িয়ে রয়েছে তাঁর সঙ্গে। এই রকমের একই দিনে জন্ম ও মৃত্যু কে বিজ্ঞান তথা মনস্তত্ত্বের ভাষায় বলা হয়’বার্থডে এফেক্ট’বা’বার্থডে ব্লু’স’। গোটা জীবনে নানান ধরনের মিথ তৈরি করেছিলেন তিনি। বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন কর্ম যোগী। একাধারে তুখোড় রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব আবার ধন্বন্তরী চিকিৎসক ও প্রশাসনিক দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার। তিনিই আবার নিয়ম করে আবৃত্তি করতেন রবি ঠাকুরের পঙক্তি। তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চিকিৎসার গুরু দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তেমনি করেছিলেন গরীব - দু:খীদের ও চিকিৎসার ব্যবস্থা। কিন্তু ডাক্তার হবার ইচ্ছে তাঁর মোটেই ছিল না তবুও এই কর্মযজ্ঞেই হয়ে উঠেছিলেন সর্বসেরা। আসলে তাঁর কর্মজীবন ছিল একেবারেই বর্ণময়। একের পর এক কীর্তি তাঁকে অবিস্মরনীয় করে তুলেছে। এমনকি তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি কিনা ’ভারতরত্ন’পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিন টি’ন্যাশনাল ডক্টরস ডে’হিসেবে পালিত হয়। তবে তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও এক আশ্চর্য অধ্যায় যা শেষ হয় এক অপূর্ব প্রেম কাহিনীতে। তিনি’প্রেম যমুনায়’সাঁতার দিয়ে ও সারাজীবন পার করছেন’একলা জীবন’। তবু ও শাহজাহানের মতো স্বপ্নিল জীবন সাথীর স্মৃতিতে গড়ে তুলেছেন কল্যাণী নগর।
বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল সহজ সরল, ডাক্তারি টেকনিক্যাল ঔষুধ দিতেন কম। তবু ও তাঁর নিকট অনেক মরণঘাতি রোগাক্রান্ত ব্যাক্তি অনায়াসেই ভালো হয়ে যেত। রোগীর মুখ দেখেই রোগ নির্ণয় করার এমন অলৌকিক বিদ্যারপ্ত করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।যে হতদরিদ্র থেকে রাজা - উজিরের কাছে তিনি ছিলেন ধন্বন্তরী চিকিৎসক। অনেকেই বলতেন যে হয়তো তাঁর দিব্যদৃষ্টি রয়েছে। তবে তিনি চিকিৎসক হিসেবে আগাগোড়াই ছিলেন স্বনামধন্য। তাঁর চিকিৎসায় রোগ নিরাময় হয়েছে সাধারণ ব্যাক্তি থেকে একাধিক দিকপাল মানুষের। বিধানচন্দ্র রায়ের নিকটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, ইন্দিরা গান্ধীর মতো ব্যাক্তিরা ও চিকিৎসা করতেন। ১৮৮২ সালের ১ লা জুলাই পাটনার ঝাঁকিপুরে এক বাঙালি হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় আবগারি দপ্তরে চাকরি করতেন।মা অঘোরকামিনী দেবী ছিলেন ধার্মিক ও একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী। তাঁর লেখা পড়া শুরু হয়েছিলো এক গ্ৰাম্য পাঠশালায়।পরে টি কে ঘোষ ইন্সটিটিউশন ও ১৮৯৭ সালে পাটনা কলিজিয়েট স্কুলে অধ্যায়ন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই এস সি ডিগ্ৰি অর্জন করেন। সেখানেই তিনি ম্যাথ অর্নাস নিয়ে বিএসসি কমপ্লিট করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস ও এমডি ডিগ্ৰি লাভ করে লন্ডন থেকে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস ডিগ্ৰি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। তবে ডাক্তার হতে গিয়ে তাঁকে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে পদে পদে। অসহযোগিতা, বাধা, চক্রান্তের পাথর ঠেলে ঠেলে তাঁকে এগোতে হয়েছে এদেশে তেমনি বিদেশে। তাঁকে এমবি পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাঁর মতো কৃতী ছাত্র কে।
শিক্ষার্জন শেষে দেশে ফিরে নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন বিধানচন্দ্র রায়।অবসর সময়ে তিনি নামেমাত্র ফি নিয়ে ব্যাক্তিগত ভাবে অনুশীলন করতেন। কিন্তু কলকাতা শহরে তখন চিকিৎসকদের ছড়াছড়ি। ফলে বিধানচন্দ্র রায়ের প্রচার প্রসার তেমন ভাবে জমে ওঠে নি। আর এরই মাঝে স্বনামধন্য শল্য চিকিৎসক নীলরতন সরকারের কনিষ্ঠ কন্যা কল্যাণী সরকারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। কিন্তু এই পরিচয় ভালোবাসার রুপ নিতে বেশি সময় নেয় নি। তাঁদের ভালোবাসার কথা নীলরতন সরকারের কানে পৌঁছে যায়। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়ের স্বল্প আয়ের জন্য নীলরতন সরকার তাঁর সঙ্গে কল্যাণী সরকারের বিয়ে দিতে রাজি হননি। ফলে কল্যাণী সরকারের সঙ্গে তিনি আর কোনো যোগাযোগ রাখেন নি। অল্প অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁর জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণে তিনি রোগী দেখার পাশাপাশি কলকাতা শহরের বুকে পার্ট টাইম ট্যাক্সি চালকের কাজ করতেন। ট্যাক্সি চালকের কাজ তথা চিকিৎসা করতে গিয়ে মানুষের মনের গভীর অনুভূতি বোঝা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে ও প্রশাসক হিসেবে তাঁর কাজে সহায়ক হয়েছে, বিশেষ করে সাধারণ লোকের আর্থিক ও মানসিক অবস্থা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে যা খুব জরুরি।
১৯৩২ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বঙ্গীয় ব্যাবস্থাপক সভার নির্বাচনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। অর্থাৎ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরেই রাজনীতিতে উত্থান ঘটে বিধানচন্দ্র রায়ের।পরে কলকাতা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও কলকাতা পৌর সংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন।১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনিত হন।১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থীরুপে আইনসভায় নির্বাচিত হন।১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলার ইতিহাসের কঠিনতম সময়ে অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতার অল্পদিন বাদেই এক ক্রান্তিকালে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িতত্বভার গ্ৰহন করেন। দেশভাগের ক্ষত, ওপার বাংলার শরনার্থীদের স্রোত, রাজ্যে কর্মহীনতা, আর্থিক সংকট সর্বোপরি খাদ্য সংকট প্রভৃতি নিরসনে তিনি অন্যন্য ভূমিকা পালন করেন। বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন এমনই এক’অখন্ড ব্যাক্তিত্ব’যার একটি পরিচয় কখনো অন্য টিকে আড়াল করতে পারে নি। তাঁর চোদ্দো বছরের মুখ্য মন্ত্রীত্ব কালে নবগঠিত পশ্চিম বঙ্গের প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছিল। এই কারণেই তিনি আজ ও’আধুনিক বাংলার রূপকার’হিসেবে পরিচিত। নিজেকে শুধু চিকিৎসার গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ রাখেন নি বরং শিক্ষা, শিল্প, রাজনীতি, দর্শন সব ক্ষেত্রেই দক্ষতা রেখে গেছেন। তিনি অবশ্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজ ( বর্তমানে এন আর এস মেডিকেল কলেজ ) এবং কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ ( বর্তমানে আর জি কর মেডিকেল কলেজ ) শিক্ষকতা করেন।১৮৪৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কার্ডিওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার প্রথম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিধানচন্দ্র রায় যাদবপুর টিবি হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, কমলা নেহরু মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন (কলেজ) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। হিন্দুস্থান মোটরস, সেন রালে দে’জ মেডিক্যাল, গ্লুকোনেট, হলদিয়া তেল শোধনাগার, রেল ইঞ্জিন কারখানা, কল্যাণী ও সল্টলেক ওপনগরী, রাজ্য বিদুৎ পর্ষদ, ব্যান্ডেল ও দূর্গাপুরে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ, হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্ৰনি ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজ, প্রভৃতি। কিন্তু ১৯৬২ সালের ১লা জুলাই ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাসভবনে যখন তাঁর জন্মদিন পালনের আয়োজনে মুখরিত তখনই দুপুর ১২ টার সময় তিনি সকল কে ত্যাগ চিরতরে বিদায় নেন। জন্মদিনের ফুলে সেজে ওঠে বিধানচন্দ্র রায়ের নিস্প্রাণ দেহ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সরকার তাঁকে দিয়েছে’ভারতরত্ন’পুরস্কার। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে কলকাতা সন্নিকটস্থ ওপনগরী সল্টলেকের নামকরণ করা হয়েছে বিধান নগর।
বিধানচন্দ্র রায় শুধু বাংলার নয়, ভারতের রত্ন ছিলেন।১৯৪৮ সাল থেকে আমৃত্যু বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তিনি বলতেন’আমি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বুঝিনা, শুধু বুঝি সাধারণ মানুষকে কত বেশি সুবিধা দেওয়া যায়।’বিধানচন্দ্র রায় মনে করতেন, নিছক আবেগ আর অত্যুৎসাহে কাজ হয় না। কি প্রয়োজন এবং কিভাবে সম্ভব, তা যুক্তি, দুরদৃষ্টি, ও সঠিক পরিকল্পনা দ্বারা স্থির করে এগোতে হবে। তিনি কোনো কাজকে ফেলে রাখতেন না অর্থাৎ তাঁর বক্তব্য ছিল আজকের কাজ আজকেই করতে হবে। তিনি কিংবদন্তি চিকিৎসক কিংবা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ও কখনো অহমিকার পরিচয় দেন নি। শাসনভার পরিচালনার ক্ষেত্রে ও প্রাধান্য দিয়েছেন বিরোধী মতাদর্শকে। তিনি নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কে বিসর্জন দিতে কখনো কুন্ঠাবোধ করেন নি। বিধানচন্দ্র রায় নিজের ফি ছাড়াই চিকিৎসা করেছেন সাধারণ মানুষের। অথচ নিজের অর্থাভাব দূরীকরণের জন্য তিনি নির্দিধায় রাজপথে চালিয়েছেন ট্যাক্সি। তাই এই কর্মবীর মানুষটি বাংলা তথা ভারতের গন্ডী ছাড়িয়ে আপামর জনসাধারণের নিকটে হয়ে উঠেছিলেন’ডাক্তার রায়’ও রূপকার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct