সজল মজুমদার, আপনজন: নদীর ধারে বাস,ভাবনা বারোমাস ‘ - বাস্তবিক অর্থেই কি তাই!!! অথচ মানব সভ্যতার বিকাশ ও কল্যাণ সাধন নদী কেন্দ্রিক সভ্যতাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। মায়ের সঙ্গে তার সন্তানের সম্পর্ক যেমন সুনিবিড় ঠিক তেমনি নদীর সাথে মানুষের। নদ নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষ কৃষিকাজ, মৎস্য শিকার, শক্তি উৎপাদন, নদী কেন্দ্রিক পর্যটন, কৃষ্টি ও ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা- প্রভৃতি প্রাচীনকাল থেকে করে আসছে। আবার এই নদীই ভরা বর্ষা ঋতুতে ভয়ংকর রূপ নেয়। আজ্ঞে হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গের অভিন্ন অন্তপ্রাণ উত্তরবঙ্গ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় নিত্যবহ ও অনিত্যবহ নদী। আত্রেয়ী, পুনর্ভবা, ইছামতি, টাঙ্গন,কুলিক, মহানন্দা, থেকে তিস্তা, তোর্ষা, জলঢাকা, কালজানি, রায় ডাক, সংকোশ এবং এগুলোর নানান শাখা নদী উপনদী উত্তরবঙ্গের প্রাণশক্তিকে প্রাচুর্য ভরিয়ে তুলেছে। উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা মিলিয়ে সর্বমোট ২০০ টিরও বেশি নদী সমূহ রয়েছে। উত্তরবঙ্গের অরণ্য অঞ্চল, পাহাড়, ঝরনা, তুষারপাত, স্নিগ্ধ তরাই ডুয়ার্স,এবং উন্মুক্ত আকাশকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এসব নদীগুলো। বর্ষাকাল চলেই এসেছে ফি বছরের মতো।যদিও প্রতিবারের বর্ষার ধরন, প্রকৃতি আলাদা আলাদা ধরনের হয়ে থাকে। দক্ষিণবঙ্গের আবহাওয়ার সাথে হাওয়া বদল ঠিক এখানেই। বর্ষাকাল আসলেই নিত্যবহ নদীগুলো যৌবনাবতী হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত জলস্ফীতির কারণে ভাঙ্গন, ধস, হড়পা বান, বাঁধভাঙ্গা বৃষ্টি বর্ষাকাল কে জনসাধারণের কাছে ভয়ঙ্কর করে তোলে। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে এই সময়েই, “ বর্ষার শুরুতেই বেসামাল উত্তরবঙ্গ” “ উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করেছে বর্ষা” “ উত্তরবঙ্গে একনাগাড়ে চলছে, ভারী বৃষ্টি” “ কয়েকদিনের মধ্যেই ফুলেঁ ফেঁপে উঠবে অমুক নদী” “ বিপদ সীমার ওপর দিয়ে বইছে জল” “ ৪৮ ঘন্টা ধরে অবিরাম বৃষ্টি” “ তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে” “ সিকিম পাহাড়ে ধস নেমে রাস্তা অবরুদ্ধ “- এসব প্রাসঙ্গিক ট্যাগলাইনগুলো সকল জনগণের মনের মধ্যেও যেন ত্রাসের সৃষ্টি করে। বৃষ্টি, বন্যা, এবং ভূমিধ্বস যেন উত্তরবঙ্গের খরস্রোতা চির প্রবাহী নদী গুলোর সমার্থক। পাহাড়ি নদী সংলগ্ন অরণ্য অঞ্চলের বন্যপ্রাণ গুলোও চরম অসহায়তার সাথে জীবন অতিবাহিত করে। অনেক বন্যপ্রাণের জীবন বিপন্নও হয়ে থাকে। ভরা বর্ষার নদীতে উত্তাল জল তরঙ্গের আতঙ্কে নাদিয়ালি মাছের সন্ধানে জেলেরা দুরু দুরু বুকে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে, ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করে থাকে। উত্তরবঙ্গের বর্ষাকালে নদীর জলস্রোতের বিকট শব্দ যেন নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মনের কোণে এক চিলটে ভয়ের জন্ম দেয়। একবার ভাবুন তো, নদী সংলগ্ন কত ভিটে মাটি বর্ষায় নদী গুলো নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় প্রায় প্রতিবছর। তথাপি নদী ভাঙ্গন রোখা গেছে কি!!! মালবাজারের হড়পা বানই হোক, কিংবা সিকিম পাহাড়ের ধস, অথবা গজলডোবার তিস্তার ভয়ঙ্কর রূপ - উত্তরবঙ্গে বর্ষাকাল কিন্তু ভয়াবহ। যদিও বৃষ্টিপাতের বিভিন্নতা এক্ষেত্রে রয়েছে। তবে উত্তরবঙ্গের গৌড়বঙ্গ অঞ্চল বর্ষার এই ভয়াবহতা থেকে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমী। এই অঞ্চলেও নদী বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অতীত ঘাটলেই স্মরণে আসবে। সামগ্রিকভাবে উত্তরবঙ্গের বর্ষাকাল নিছকই বৃষ্টিপাতের আনন্দকে উপভোগ করবার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ বাসীদের ক্ষেত্রে দুর্ভোগ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ব উষ্ণায়নের সময়ও উত্তরবঙ্গে বর্ষাকাল যেন তার ঝোড়ো ইনিংসের দাপট এখনো বজায় রেখে চলেছে,আগামীতেও থাকবে আশা রাখছি।।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct