মুদাসসির নিয়াজ, আপনজন: আমরা যারা হররোজ ট্রেনে-বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে কলকেতা বা শহরতলিতে কাজ করতে আসি, তারা সাধারণত বাস থেকে নেমে কিছুটা পদব্রজে কর্মক্ষেত্রে যাই। অফিস যেতে ফুটপাত আমাদের সবেধন নীলমণি। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। হাওড়া স্টেশনের সাবওয়ে থেকেই শুরু হয়ে যায় হকারদের উপদ্রব বা দৌরাত্ম্য। চব্বিশ ইনটু ছয় – দুবেলা চলে আমাদের যন্ত্রণাময় পদচারণা। ইডলি-ধোসা, মোমো, রোল-চাউ-মোগলাই, ঝালমুড়ি, পেয়ারা, চা-বিস্কুট, বিড়ি-সিগারেট, খৈনি-গুটখা থেকে শুরু করে খবরের কাগজ, রুমাল, মোবাইলের কভার, হেডফোন আরও কত কী বসে পসরা সাজিয়ে। দেদার চলে রমরমা ব্যবসা। আর যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের। ফুটপাতের এইসব অস্থায়ী দোকানদারদের মেজাজ বা টেম্পার এত বেশি যে, মুখ লাগানোই মুশকিল। কথা কাটাকাটি থেকে বচসা শুরু হলে ওদের লোকজন এসে রীতিমতো চোখ রাঙিয়ে, কলার ধরে, গলা ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে যাবে অজানা গন্তব্যে। যেন আপনি মিস্টার ডেলি প্যাসেঞ্জার অপরাধী।
তাই উপরি পাওনা হিসবে কদাচিৎ জুটতে পারে, ‘চল ফোট ইঁহাসে’ কিংবা ‘মারেগা ঝাপ্পড়, জিন্দেগী ভর ইয়াদ রহেগা’ ইত্যাদি অমৃত ভাষণ। কখনও সখনও আরো আগে বেড়ে যা শুনতে হয়, তা আর কহতব্য নয়। এদের অধিকাংশই অবাঙালি। মগের মুলুক নাকি রে বাবা। আমরাও তো রক্ত মাংসের মানুষ। এমন অভব্যতা আলবাৎ আপনার আমার আত্মসম্মানে লাগে, লাগবে, লাগারই কথা। অগত্যা আমরা কেউ কেউ এর বিহিত চেয়ে নিরূপায় হয়ে পুলিশের কাছে যাই। বিশেষ করে যারা একটু রাশভারি লোক, তারা এর শেষ দেখে ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করে বসেন। কিন্তু পেট বড় বালাই। ওদেরও তো খিদে পায়। আর খিদে পেলে ওরা ইয়ে (উহ্য) খায়। আপনার আমার মতো ভাত তরকারি খেলেও এদের পেট ভরে না। তাই ওরা কেয়ার অফ ফুটপাতওয়ালাদের থেকে মাসোহারা নেয়। গোদা বাংলায় বললে, তোলা নেয় বা ঘুস খায়।
পুলিশ, দাদা, মাস্তান, সিকি-আধুলি মার্কা নেতা এবং সর্বোপরি হকারদের সম্মিলিত দাপটে ফুটপাত এখন ফুডপাথে পরিণত হয়েছে। কলকাতা থেকে শুরু করে জেলা শহরতলির রাস্তাগুলোরও একই দশা। অর্থাৎ ফুটপাত এখন আর ফুটপাত নেই, বেশিরভাগই চলে গেছে দখলদার ও হকারদের কব্জায়। কোথাও গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা, হনুমানজীর বেদী বা মন্দির, কোথাওবা ত্রিপল খাটানো অস্থায়ী তাঁবু। যেখানে খেটে খাওয়া কুলি-মুটে মজদুররা রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়েছে। কোথাও ফুটপাতের ওপর তৈরি হয়েছে মোটর মেকানিক গ্যারেজ। কালিঝুলি মেখে কর্ণবিদারী আওয়াজ, আর কালো ধোঁয়া ছাড়ছে সাইলেন্সার থেকে। কোথাও বাঙালির বহুবচনের তুফান তোলার জন্য চায়ের দোকান। সকাল-সন্ধ্যা টিফিন করার জন্য ঘুগনি কিংবা আলুরদম-মুড়ি অথবা তেলেভাজার দোকান। কোথাও ক্ষুর-কাঁচি নিয়ে বসেছেন কম পয়সার নাপিত ভায়া। কত রকম ছোটখাট ব্যবসা যে ফুটপাতে জাঁকিয়ে বসেছে, তার ইয়ত্তা নেই।
মাঝে মধ্যে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অভিযান চালানো হয়। তখন অন্তত কয়েকদিনের জন্য হলেও ফুটপাতগুলি পথচারীর চলাচলের উপযোগী হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই ফের দখল হয়ে যায় উদ্ধারকৃত ফুটপাত। মহামান্য ফুটপাত বাবাজী আবার যে কে সেই বা তথৈবচ হয়ে যায়। সাধু ভাষায় বললে, শ্রীমান ফুটপাত তার স্বমহিমায় ফিরে যায়। এ যেন চোর-পুলিশ বা রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা। খেলা হবে নয়; এই খেলা মান্ধাতা আমল থেকেই চলছে। এর নেপথ্যে যারা থাকে, তারা জগন্নাথ নয়; তাদের হাত যথেষ্ট লম্বা। কর্তাব্যক্তিদের হাত থাকার পাশাপাশি থাকে হরেক রকম অজুহাত। অনেকে বলেন, এভাবে এত মানুষের পেটে লাথি মারাটা কি ঠিক? বিজ্ঞ মহল থেকে দাবি তোলা হয়, পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করার পরেই হকার উচ্ছেদ বা ফুটপাত দখল-মুক্ত করা উচিত। না হলে শহরে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই বাড়বে। শহরবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। এমন ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত কর্ণকূহরে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে চাক্কি পিষিং ছাড়া আমরা জনতা জনার্দনের কী বা করার থাকে। বেশি কথা বললে, নিজের চরকায় তেল দেওয়ার মতো উপদেশ শুনতে হয়।
যাহোক, একথা অনস্বীকার্য যে, ফুটপাত বে-দখল বা জবরদখল হয়ে যাওয়ায় পথচারীদের বাধ্য হয়েই রাস্তার ধার দিয়ে চলাচল করতে হয়। এর ফলে অনেক সময় পথচারীদের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। জীবনহানিও হয়। একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, সরকার বা প্রশাসনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ফুটপাত দখলমুক্ত করা বাঁয়া হাত কা খেল। কিন্তু তারপর কী হবে? কোথাকার জল কোথায় গড়াবে? অগত্যা সরকার ব্যাকফুটে চলে যেতে বাধ্য হল। কেউ বলছে, কর্পোরেট মহলের চাপে ফুটপাতকে হকার বা দখলমুক্ত করার কাজ চলছিল। তাদের যুক্তি, কম পয়সায় কেনাকাটা কিংবা খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলে, শপিং মল কি মাছি তাড়াবে? বাবুদের ভুরিভোজ ও রসনাতৃপ্তির জন্য নামিদামি ঝাঁ চকচকে হোটেল- রেস্টুরেন্টগুলো কি ভ্যারেন্ডা ভাজবে? তাই সব দিক বিবেচনা করে সাপও না মরে, আবার লাঠিও না ভাঙে – এমন ব্যালেন্স করে চলতে হয় প্রশাসন ও সরকারকে।
কিন্তু এটা তো ঠিক যে, অপারেশন সানশাইন বা ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারলে যানজট অনেকখানি কমে যাবে। এই যনজট মুক্ত করতেই সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে শহরের বুকের ওপর একের পর এক উড়ালপুল, ফুট ওভার, আন্ডারপাস বা সাবওয়ে কতকিছু বানিয়েছে। তাতেও কিন্তু গণপরিবহনে পর্যাপ্ত গতি আসেনি। মিছিল-নগরী কলকাতার চাক্কা সোম থেকে শনি পুরো জ্যামই থাকে। ধর্মতলা থেকে হাওড়ার মতো ১০-১২ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে আধা ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ওয়েস্ট হয়। আর এই একবিংশ শতাব্দীতে সবথেকে দামি হল সময়। একটুখানি সময় বাঁচাতে মানুষ কত পয়সা খরচ করে। কিন্তু বিশেষ করে সারাদিনের কাজকাম সেরে বাড়ি ফেরার পথে বাসেই ড্রেনেজ হয়ে যায় অনেকটা সময়। অথচ ঘড়ির কাঁটায় ২৪ ঘণ্টাতেই দিন-রাত। এর মধ্যেই সবকিছু সারতে হবে।
ফুটপাত হকার মুক্ত হলে মানুষ বা নিত্যযাত্রীরা গণপরিবহনে চড়ে স্বস্তি পাবে। শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। শহরের হাল বা স্বাস্থ্য ফিরবে। মানুষ ফুটপাত দিয়ে পায়ে হেঁটে স্বচ্ছন্দে নির্ধারিত সময়ে স্বল্প দূরত্বে পৌছাতে পারবে। কল্লোলিনী কলকাতার অহংকার ও অলংকার রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলের জ্বালায় যানজটে আটকা পড়লে মানুষ বাস থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌছতে পারবে। পথচারীদের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার কমবে। কিন্তু এলিট বাবুরা তো চারচাকা পার্কিং করে টেরি বাগিয়ে গটমট করে আমিনিয়া, রয়্যালে ঢুকে যাবেন কিংবা শপিং করতে বিগ বাজার, সিটি মার্টে এন্ট্রি নেবেন। আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের আটপৌরে লোকেরা কোথায় যাবে, কোথায় খাবে, কোথায় পটল মুলো ঝিঙে ঢ্যাঁড়স ইত্যাদি খরিদ করবে?
সব দিক ভাবতে হবে বৈকি। সরকার তো সবার। বাঙালির-অবাঙালির, ঘটির-বাঙালের সব্বার। আর পাঁচটা বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও মেরিটস-ডিমেরিটস বা ভাল-মন্দ উভয় দিকই আছে। তাহলে করণীয় কী? শুনো হে পাঠকগণ, যাহা করিতে হইবে তাহা এক্ষণে করিলাম বর্ণন। বন্ধ করিতে হইবে ফুটপাত বিক্রি, লিজ বা ইজারা দেওয়া, বন্ধ করতে হবে তোলাবাজি-মাসোহারা, হটাইতে হইবে দালালচক্র, লাগাম পরাতে হবে দুর্নীতিবাজ কাউন্সিলর বা ওয়ার্ড মেম্বারদের দাদাগিরিতে। শোনা যায়, এসব টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নাকি অনেক উপরতলা পর্যন্ত চলে যায়। এই অশুভ পরম্পরার অবসান হোক। সবাই মানবিক হোক, সবার শুধবুদ্ধির উদয় হোক, সবাই সংবেদনশীল হোক – এই কামনা করি। তবেই ফুটপাত হবে পাবলিকের, পথচারীদের। সেই সোনালি দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct