আপনজন ডেস্ক: বৌবাজারের ‘উদয়ন’ হস্টেলের মধ্যে মোবাইল চোর সন্দেহে এরশাদ আলমকে আবাসিকরা পিটিয়ে মারে। সেই ঘটনায় ধৃত ১৪ জনকে শনিবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হলে তাদেরকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেয় আদালত। পুলিশের তরফে ১৪ দিনের হেফাজতের আবেদন করা হলেও আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত ধৃতদের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ মেলে আদালতের তরফ থেকে।
শহর কলকাতার বুকে এভাবে চোর সন্দেহে রাস্তা থেকে তুলে এনে হস্টেলে মধ্যে হত্যা করার ঘটনায় তদন্তে নামেন কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা।
ধৃতদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে চাঞ্চল্যকর তথ্য কলকাতা পুলিশের হাতে এসেছে। ধৃতেরা হলেন ঝাড়গ্রামের উমুল হাঁসদা, বাঁকুড়ার পবিত্র মুর্মু, মুর্শিদাবাদের সুবীর টুডু, ঝাড়গ্রামের হিমাংশু মাণ্ডি, জলপাইগুড়ির মনোজ সরকার, নদিয়ার প্রদীপ দাস, মালদহের কার্তিক মণ্ডল, রাজেশ কর্মকার, দক্ষিণ দিনাজপুরের রানা হেমব্রম, পশ্চিম মেদিনীপুরের শুভঙ্কর মাণ্ডি, হুগলির প্রিয়ম মণ্ডল, নদিয়ার ঋতম হালদার, কোচবিহারের শঙ্কর বর্মন এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার দূত কুমার মণ্ডল।
জানা গিয়েছে, ধৃতদের বিরুদ্ধে খুন, তথ্য প্রমাণ লোপাট, অস্ত্র আইন-সহ একাধিক ধারা দিয়েছে কলকাতা পুলিশ। হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দাদের পাশাপাশি স্থানীয় মুচিপাড়া থানার তরফ থেকেও এই ঘটনায় একটি পৃথক তদন্ত চালানো হচ্ছে। ওই তদন্তের প্রক্রিয়ার মাথায় রয়েছেন কলকাতা পুলিশের ডিসি(সেন্ট্রাল)-সহ বেশ কয়েকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার আধিকারিক। এই ঘটনার আর কারা কারা যুক্ত রয়েছে, তাও খতিয়ে দেখছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। শুক্রবার রাতে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ ৷ সেখান থেকে ক্রিকেট খেলার একাধিক ব্যাট উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে । একটি ব্যাট ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
পুলিশ সূত্রে আরও খবর, ভিম নাগ মিষ্টির দোকানের সামনে নির্মল চন্দ্রে স্ট্রিটে এরশাদ কফি কিনতে গিয়েছিলেন। তখনই স্থানীয় এক মুদি ব্যবসায়ী বলে ওঠেন, চোর যাচ্ছে। তার সেই কথা শুনে হস্টেল থেকে ছুটে আসে সেখানকার একদল আবাসিক। তারা এরশাদকে রাস্তা থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায় হস্টেলের মধ্যে। তার পর চলে ব্যাপক মারধর। পুলিশ এসে এরশাদকে উদ্ধার করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। শনিবার নিহত এরশাদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট মিলেছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট না মিললেও পুলিশে হাতে যে প্রাথমিক রিপোর্ট এসেছে তাতে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। লালবাজার গোয়েন্দাদের হাতে ময়নাতদন্তের যে প্রাথমিক রিপোর্ট হাতে এসেছে সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, যুবককে ভোতা এবং ভারী কিছু দিয়ে মাথায় বারংবার আঘাত করা হয়। তার পায়ে এবং হাঁটুতে একাধিকবার আঘাত করে দুটি পা ভেঙে দেওয়া হয়। পরে যুবকের হাত এবং বুকেও মারধর করা হয়। পুলিশের অনুমান, এরশাদের পায়ে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে আঘাত করায় তার পা ও হাঁটু ভেঙে গিয়েছে। তবে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে এরশাদের মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতালের চিকিৎসক সূত্র পুলিশকে জানিয়েছে।
অন্যদিকে, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা ধৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছেন, তারা এরশাদকে মারধরের প্রমাণ লোপাট করতে সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলে দিয়েছেন। আরও জানা গেছে, ‘উদয়ন’ হস্টেলের পাশে থাকা একটি কম্পিউটার দোকানে ছিল সিসিটিভি। হস্টেলের আবাসিকরা যখন এরশাদকে হস্টেলে মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে মারধর করে তখন জনা কুড়ি আবাসিক এসে ওই কম্পিউটারের দোকানে হানা দেয়। তাদের মধ্যে ছিল ধৃতরাও। তারা কম্পিউটার থেকে সিসিটিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখে। তারা সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পায় এরশাদকে হস্টেলে মধ্যে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রমাণ লোপাট করতে তারা কম্পিউটার খুলে হার্ড ডিস্ক থেকে সেই সব সিসিটিভির ফুটেজ ডিলিট করে দেয়। ওই কম্পিউটার দোকানের মালিক নাকি আবাসিকদের এই কাণ্ডের কথা জানিয়েছেন তদন্তকারী পুলিশকেও। ফলে, এরশাদ হত্যার তথ্য প্রমাণ পাওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা হস্টেলের মধ্যে থাকা সিসিটিভির কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। তা থেকে এরশাদকে মারধরের প্রকার জানা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লালবাজার সূত্রের খবর, সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল তা জানতে ধৃত আবাসিকদের প্রত্যেকের বয়ান নেওয়া হবে।
গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী ধৃতদের মধ্যে ১২ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া এবং বাকি দু’জন প্রাক্তন ছাত্র। এই দুই প্রাক্তন ছাত্রের পরিচালনায় এরশাদকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যাচ্ছে। ধৃতদের থেকে নেওয়া বয়ান মিলিয়ে দেখা হবে কোনও অসঙ্গতি আছে কিনা। সেই বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে বলে জানান গোয়েন্দারা।
অন্যদিকে, বেলগাছিয়ার ১/৭ জীবনকৃষ্ণ রোড ঠিকানায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন এরশাদ। পরিবার বলতে তার স্ত্রী সালমা বিবি, দুই সন্তান এশরাদ পরভিন ও ছেলে ওয়াকার আলম এবং এরশাদের দিদি মদিনা বেগম। মাসে ১০০ টাকা ভাড়া দিয়েই কোনওরকমে গলির মধ্যে ধাকা ছোট্ট ঘরে দিন গুজরান করতেন। পরিবারের উপার্জনকারী বলতে ছিলেন একা এরশাদ। তার মৃত্যুতে অথৈ জলে স্ত্রী সালমা বিবি। । সালমা বিবির চিন্তা কি করে দুই সন্তানের মুখে অন্ন জোটাবেন। আর কি করেই বা মাস গেলে ১০০ টাকা ঘর ভাড়া মেটাবেন। তার স্বামী এরশাদের নির্মম মৃত্যু শোরগোল ফেলে দিলেও এখন মুখ্যমন্ত্রী কিংবা রাজ্য সরকারের তরফে কোনও ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়নি। তবে, এই মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। মনে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা প্রশাসনের হাত থেকে সরে যাচ্ছে।
কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম গণপিটুনির ক্রমবর্ধমান ঘটনা প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে, পুলিশ পর্যন্ত যাওয়ার মানসিকতাই নেই। ঘটনা ঘটেছে, এক্ষুনি কিছু করতে হবে। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক এক সঙ্কেত। আমি সাধারণ মানুষকে বলব, আইন নিজের হাতে নেবেন না। এটা পুলিশের ব্যর্থতা নয়। তার জন্য একটা মাস কাউন্সেলিং দরকার।
তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও এ বিষয়ে কোনও মুখ খোলেননি। সঙ্গত কারণে তাই প্রশ্ন উঠছে, এরশাদ আলম হত্যার খুনিদের কি বিচার হবে? এরশাদ আলম কি ন্যায় বিচার পাবেন? এই ঘটনা স্মৃতি ্শউসকে দিয়েছে বছর আগে, ২০১৪ সালে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে ভিক্ষাবৃত্তি করা ও মানসিক ভারসাম্যহীকন কোরপান আলিকে হত্যার। কোরপান আলিকে মোবাইল ফোন চুরির সন্দেহে ডাক্তারি পড়ুয়ারা পিটিয়ে খুন করেছি। সেই ঘটনার প্রায় পুনরাবৃত্তি বৌবাজারের সরকারি হস্টেলে এরশাদ আলমকে পিটিয়ে মারার ঘটনা। এখনও কোরপান আলির ঘাতকদের বিচার হয়নি, হয়নি কোনও শাস্তি। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে। এরশাদ আলম খুনের ঘটনা তাকেই হয়ত অনুসরণ করে চলবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct